![](http://writermiltonbiswas.com/wp-content/uploads/2020/06/hfjfjjfg20200601070429.jpg)
ড. মিল্টন বিশ্বাস
আজ ১ জুন গণমুখী সাংবাদিকতার দিশারি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫১তম মৃত্যুবার্ষিকী। এই নির্ভীক ও ক্ষণজন্মা সাংবাদিক ১৯৬৯ সালের এই দিনে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।তিনি ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।২০২০ সালের এই ‘মুজিববর্ষে’ তাঁকে স্মরণ ও শ্রদ্ধা জানানোর মোক্ষম সময় এসেছে। যদিও করোনাভাইরাসের মহামারিতে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই; তবু তিনি সকলের কাছে উচ্চারিত একটি মহিমান্বিত নাম।
২.
ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কলাম লিখতেন ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গ-মঞ্চ’ ছিল তাঁর সেই নিয়মিত কলামের শিরোনাম। তাঁর কলামের বিষয়বস্তু ছিল দেশ-বিদেশের সমকালীন প্রসঙ্গ। নির্ভীক সত্যকথন, অনন্য রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা আর গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই তিনি তৎকালে পাঠকদের মন জয় করে বর্তমান কালেও প্রাসঙ্গিক হয়ে আছেন। আজ আমরা যারা দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখি তারা ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং বিশেষ দলের পক্ষে সরাসরি ওকালতি করে থাকি; নিরপেক্ষ কলামিস্ট নেই বললেই চলে; সেখানে ‘মোসাফির’ গণমানুষের পক্ষে কথা বলে গেছেন আমৃত্যু। পাকিস্তানি শাসকদের জেল-জুলুম, প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত ও ইত্তেফাক বন্ধ করেও তাঁকে দমানো যায়নি। বরং তিনি ফিনিংক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে পুনরায় নবোদ্যমে পাখা মেলেছেন মুক্ত আকাশে। আগেই বলেছি, ১৯৬৯ সালের ১ জুন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে এই মহতী মানবের অকাল প্রয়াণ ঘটে। তাঁর ‘রহস্যময়’ প্রয়াণ ছিল গণজোয়ারে প্লাবিত দেশের জন্য অশনিসংকেত। কারণ তাঁর লেখনি ছিল শোষিত মানুষের প্রত্যাশা, হতাশা আর প্রতিরোধের উদ্দীপন বিভাব। অর্থাৎ বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে মানিক মিয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত এসত্য তাঁর লিখিত কলামগুলো পাঠ করলেই স্পষ্ট হয়। বাস্তবতা হলো তাঁর কলাম ‘মোসাফির’ না থাকলে দেশে গণ-আন্দোলন দানা বেঁধে উঠত না। ষাটের দশকে তাঁর লেখা পড়েই ছাত্ররা আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল; মানুষ রাজনীতি সচেতন হয়ে উঠেছিল। সমাজ সচেতনতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কলামের মধ্যে। রাজনীতি ছাড়াও তাঁর কলামে স্থান পেয়েছে অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ জীবনঘনিষ্ঠ নানান প্রসঙ্গ।
৩.
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সাংবাদিকতা জীবনের সূচনা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আবুল মনসুর আহমদের সম্পাদনায় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ পত্রিকা দিয়ে। ১৯৪৮ সালে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরের ব্যাপারে চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতায় সে প্রচেষ্টা ছিল ব্যর্থ। ১৯৪৯ সালে মানিক মিয়া পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। একই বছর আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটলে এই নতুন দলের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’। তখন তিনি এ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৪৯-৫০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে তথ্য দপ্তরের ডেপুটি সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগও দিয়েছিল, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৫১-এর ১৪ আগস্ট মানিক মিয়া সাপ্তাহিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদনাসহ পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯৫৩ সালে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’ তাঁরই সম্পাদনায় দৈনিকে রূপান্তরিত হয়।
মানিক মিয়া ছিলেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির অন্যতম পথিকৃৎ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক অনুসারী। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পেছনে ইত্তেফাক সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। আর এক্ষেত্রে তাঁর কলামগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কেবল কলাম নয় সামরিক আইন ভাঙা, ঐতিহাসিক ৬-দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন এবং ইত্তেফাকে সে বিষয়ে বক্তব্য-বিবৃতি প্রকাশ করায় একাধিকবার তাঁকে কারাভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দৃঢ়চিত্তের অবস্থান ছিল সবসময়ই আপসহীন। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির অনুসারী। সামাজিক শোষণ ও নিপীড়ন থেকে গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন আমৃত্যু। এদেশে বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। উপমহাদেশের দাঙ্গা ও দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর মানবিক বোধের উন্মেষ ঘটায়। ১৯৬৪ সালে ঢাকায় সাম্প্রদায়িক সংঘাত শুরু হলে তিনি দাঙ্গা প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর দেয়া ব্যানার হেডিং ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ ইত্তেফাকসহ বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হয় সেসময়।
সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা লিখতে গিয়ে তিনি জেলে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন একাধিকবার। ১৯৫৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সামরিক আইন লঙ্ঘনের মিথ্যা অভিযোগে মানিক মিয়া গ্রেফতার হন; আজীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেছেন কিন্তু আপস করেননি। তাঁর সম্পত্তি সামরিক সরকার কখনো বাজেয়াপ্ত করেছে, কখনো বিনষ্ট করে দিয়েছে। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হলে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জননিরাপত্তা আইনে ৬ ফেব্রুয়ারি মানিক মিয়াও গ্রেফতার হন। এসময় দেশে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। মানিক মিয়া এ আন্দোলনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। সে বছর কারাগার থেকে ১৪ আগস্ট মুক্তি লাভ করেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, রাষ্ট্রপক্ষ থেকে যত নিপীড়ন-অত্যাচার বেড়েছে, ততই সক্রিয় হয়েছে মানিক মিয়ার ইত্তেফাক। উচ্চ আদর্শ ও সততার কারণে সরকারের অন্যায় কাজের কঠোর সমালোচনা সম্ভব হয়েছিল। ৬ দফা আন্দোলনকে সমর্থন করায় তিনি ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন পুনরায় গ্রেফতার হন। সেসময় ইত্তেফাকসহ তাঁর ‘ঢাকা টাইমস’ ও ‘পূর্বাণী’ বন্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস ১৬ জুন বাজেয়াপ্ত করা হয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে ১৯৬৭ সালে ঢাকার পুলিশ হাসপাতাল থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালে দুর্বার গণ-আন্দোলনের মুখে পত্রিকা ও প্রেস মুক্ত হয় এবং ১০ ফেব্রুয়ারি পৌনে তিন বছর পর পত্রিকাটি কেবল তাঁর অবিচল মনোবলের কারণে পুনরায় প্রকাশ হতে থাকে।
৪.
‘সাপ্তাহিক ইত্তেফাক’ থেকেই মানিক মিয়া মোসাফির ছদ্মনামে ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ কলাম লিখতে শুরু করেন। কলামগুলোতে সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে জনগণের বোধগম্য ভাষায় রাজনৈতিক বক্তব্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা হতো। এগুলো পরবর্তীতে আরও পরিশীলিত রূপ লাভ করে দৈনিক ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে। লেখাবাহুল্য, পাকিস্তানের রাজনৈতিক হঠকারিতা, বৈষম্য, বঞ্চনা ও বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আগ্রাসন তিনি শুরু থেকে আঁচ করতে পেরে ইত্তেফাকে কলাম লিখতে শুরু করেন। রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়কে তিনি অভিন্ন ও অবিচ্ছেদ্য মনে করতেন। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ নিবন্ধসমূহে মোসাফির তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ নেতাদের কথায় ও কাজে গরমিল, বক্তব্য-বিবৃতিতে স্ব-বিরোধিতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। এদেশের লোকমুখে প্রচলিত অনেক গল্প নতুন ব্যঞ্জনা পেয়েছে তাঁর লেখায়। যেমন ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল প্রকাশিত ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’র একটি অংশে ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যু নিশ্চিত জানার পর জনৈক ব্রাহ্মণ-শিষ্য কর্তৃক রাজাকে বোকা বানানোর যে গল্প বর্ণিত হয়েছে তা সত্যিই অভিনব। তৎকালীন সরকারের ‘নিরাপত্তা’ আইনের যথেচ্ছ ব্যবহারকে ব্যঙ্গ করেছেন কলামিস্ট। জনগণের পরিচিত গল্প দিয়ে রাজনৈতিক কলাম লেখায় সেসময় মোফাফিরের লেখাগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মুসলিম লীগের একচ্ছত্র আধিপত্যের যুগে জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রগতিশীলতার চর্চা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন মানিক মিয়া। যে ভাষায় ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’ লেখা হতো সেই তীব্র-তির্যক ভাষায় দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৫৩ সাল থেকে কলাম লেখা শুরু করে মোসাফির তা অব্যাহত রাখেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত।
এখানে কলামের বিষয়ে ছিল জনগণের অভাব, অভিযোগ, সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা অন্যদিকে ছিল ক্ষমতাসীন পাকিস্তানি শাসকদের গণবিরোধী শক্তির স্বরূপ উন্মোচন। একইসঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান বিরোধী রাজনীতিকদের সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের অপপ্রচার ও কুৎসা রটনার সমুচিত জবাব দিয়েছেন। তিনি ১৯৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনের পূর্বে গণতন্ত্র ও গণ-অধিকারের সপক্ষে জনমত গঠন করেন যেমন, তেমনি বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নানান ব্যর্থতা নিয়ে সমালোচনাও করেছেন। গণতন্ত্রের বৃহত্তর স্বার্থে মানিক মিয়া সোহরাওয়ার্দী সরকারকে সমর্থন করতেন। কিন্তু মোসাফির হিসেবে ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে তাঁর ভূমিকা সবসময় একই রকম ছিল না। তিনি তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের আতাউর রহমান সরকারের খাদ্যনীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন। এই সরকারের অনেক কাজের সমালোচনা করে মোসাফির যেসব কথা লিখতেন, তা অনেকের কাছে মনে হতো বিরোধী দলের বক্তব্য।
মোসাফির কখনো একদলের বা একমতের সমর্থক হয়ে তাঁর কলাম লেখেননি। তখনকার পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত দুঃসময়ের প্রতিকারের জন্য কলম চালিয়েছিলেন তিনি। এমনকি বাকসর্বস্ব তথাকথিত জনদরদী বাম নেতাদের স্বরূপ জনসমক্ষে তুলে ধরেছিলেন। ইত্তেফাকের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও দলীয়ভাবে পত্রিকাটি বর্জনের হুমকির মধ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘ইত্তেফাকের ঘাড় হইতে দলীয় রাজনীতির ভূত নামিয়া গেলে ইত্তেফাকের পক্ষে সত্যিকার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ সহজ হইবে। ইত্তেফাক যদি প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিতে না পারে তাহা হইলে কোনো দলের মুখপত্র হিশেবে বা পৃষ্ঠপোষকতায় টিকিয়া থাকিতে পারিবে না।’ এই কথার মধ্য দিয়ে আপসহীন সাংবাদিকতায় নিষ্ঠাবান মানিক মিয়াকে সহজেই চেনা যায়। তাঁর জীবনাচরণ, লেখায় এবং নীতির প্রশ্নে তিনি ছিলেন নির্দ্বন্দ্ব। আসলে কলামিস্ট মোসাফির জাতীয় স্বার্থে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কলম চালিয়েছিলেন; দলের স্তুতি করেননি। গণরাজনীতি করেছেন এবং গণরাজনীতির সবচাইতে বড় দলটি তার সমর্থন পেয়েছে মাত্র। একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতা ভিন্ন। এখনকার পত্রিকাগুলো বড় বড় ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় বের হয়। সম্পাদকরা মানিক মিয়ার মতো নির্ভীকতা দেখাতে পারেন না; সামাজিক ব্যাধি দূর করার জন্য চেষ্টাও করেন না।
৫.
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার মানিক ভাই’ নিবন্ধে লিখেছেন- ‘রাজনীতি সম্পর্কে মানিক ভাই’র ধারণা ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্বচ্ছ। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন মানুষের অধিকারের বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। তখন মানিক ভাই’র মাঝে এদেশ এবং দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি যে ভালবাসা লক্ষ্য করেছি, তা আমাকে অভিভূত করেছে। মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা এবং অনুভূতির প্রখরতা এত সুগভীর ছিল যে, মানুষ কি চায়, কি ভাবে- সহজেই তিনি তা বুঝতে পারতেন এবং তা’ তুলে ধরতেন লেখনীর মাধ্যমে।’(অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া, পৃ ৯) বঙ্গবন্ধু তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেতেন, তাঁকে আস্থার জায়গা ও রাজনৈতিক দিকদর্শক মনে করতেন।
মানিক মিয়ার রাজনৈতিক চেতনা এবং রাজনীতি সম্পৃক্ত রচনার সূচনা বলা যায় আবুল মনসুর আহমেদ সম্পাদিত ‘ইত্তেহাদ’ থেকেই। আবুল মনসুর আহমদ লিখেছেন- ‘রাজনীতিতে ছিলেন তিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাগরিদ। তাঁরই প্রেরণায় মানিক মিয়া সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। সোহরাওয়ার্দীর দেশপ্রেম, রাজনৈতিক আদর্শবাদ, দুর্জয় সাহস, অমিত তেজ, বেপরোয়া ত্যাগ, স্বচ্ছ চিন্তা, সরল যুক্তি, কুশল-প্রকাশভঙ্গি এবং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা সবই তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।’ তিনি যেকোনো বিপদের মোকাবেলা করতেন দুঃসাহসের সঙ্গে। সমাজ, রাষ্ট্র আর বৃহত্তর জনতার স্বার্থ যেখানে জড়িত- তা এমন বৃহৎ ও মহৎ বস্তু যে তার জন্য নিবেদিত হয়ে নির্যাতনও মুখ বুজে সহ্য করতেন। বিপদের ঝুঁকি নিতেন; প্রতিবাদে পিছ পা হননি কখনও। বলা হয়ে থাকে সংবাদপত্র সমাজের তাৎক্ষণিক চেহারা দেখায়; কিন্তু জাতীয় জীবনেও তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে একথা মানিক মিয়ার লেখনি থেকে প্রমাণ করা যায়।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে নির্ভীকতার আদর্শ ও ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তিনি। ইত্তেফাক কর্তৃক প্রকাশিত ‘অবিস্মরণীয় মানিক মিয়া’ (১৯৯৫) গ্রন্থে মোসাফিরের ডায়েরি, বেশ কিছু ভাষণ এবং ৪৫টি কলাম সংকলিত হয়েছে। কলামের বিষয়গুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ। ১৯৫৪ সালে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে গ্রামের জনৈক পাঠকের চিঠির জবাবে তিনি জনতার ঐক্যজোটের উপর গুরুত্বারোপ করে কলাম লিখেছেন। ১৯৫৫ সালে সিন্ধু প্রদেশের মন্ত্রিত্ব নিয়ে ভাঙা-গড়ার খেলা তথা পাকিস্তানের অস্বস্তিকর রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করেছেন। ১৯৫৬ সালে নিউজপ্রিন্টের দুষ্প্রাপ্যতা ও এ বিষয়ে সরকারি শাসনযন্ত্রের একচোখা নীতির সমালোচনা করেছেন। একই বছর মিশর থেকে ইংরেজ-ফরাসি সৈন্য অপসারণ এবং এ বিষয়ে সমাজতন্ত্রী রাশিয়া ও পশ্চিমা শক্তিবর্গের ভূমিকা পর্যালোচনা করে লিখেছেন কলাম। ১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহ পরিণতি ও মোহাজের সমস্যার পর্যালোচনা করেছেন। ১৯৬৯ সালে বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার উল্লেখপূর্বক ‘রঙ্গ-মঞ্চ’ শীর্ষক কলাম লিখেছেন। এভাবে বহু সংখ্যক কলামের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর মৌলিক চিন্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন।
আসলে কলাম লেখার মধ্য দিয়ে মোসাফির দেশের রাজনীতিকে প্রভাবান্বিত করেছিলেন। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিক আয়োজনে সকল প্রতিবন্ধকতা মুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ সম্প্রদায় নির্বিশেষ বাঙালি জাতির কবি- এই প্রত্যয় সেদিন লেখনিতে ব্যক্ত করেন মানিক মিয়া। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারির দাঙ্গাবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের প্রধান উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন তিনি। আসলে কলামের মধ্য দিয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ পরিবেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সমান্তরালে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে প্রেরণাদানকারী চালিকা শক্তির ভূমিকা পালন করেন তিনি। বাংলার প্রতিটি আন্দোলন, ১৯৪৮-৪৯ সালের আন্দোলন, ৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ৬২টির শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন, ৬৪ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ৬৬’র ৬-দফা এবং ৬৮-৬৯ ছাত্র আন্দোলনে তথা গণ-অভ্যুত্থানে তাঁর সম্পাদিত ইত্তেফাক নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে।
৬.
কলামের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের মুখোশ উন্মোচন করেন মানিক মিয়া। ১৯৫৭ সালে মোসাফিরের কলামে পাকিস্তানে অশুভ শক্তির উত্থান অনিবার্য বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল। সেই আশঙ্কা ১৯৫৮ সালেই সঠিক প্রমাণিত হয়। এজন্য অত্যাচারী শাসকচক্র তাঁর লেখা সহ্য করতে পারেনি। ১৯৫৮ সালের আইয়ুব খানের মার্শাল ল’ জারি হলে কড়া বিধি-নিষেধের কারণে সংবাদপত্র এক ধরনের চাপে পড়ে যায়। কিন্তু এসময় মানিক মিয়া মোসাফির ছদ্মনামে তাঁর নিজস্ব কলাম ‘রঙ্গ-মঞ্চ’-এ ১৭ অক্টোবর কৌশল করে লিখেছেন- ‘যে কোনো দেশের সামরিক বাহিনীকে স্থায়ীভাবে শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হইলে তাদের নিজস্ব দায়িত্ব পালনে অর্থাৎ দেশরক্ষা ব্যবস্থায় শৈথিল্যের ভাব দেখা দিতে পারে। কারণ একই লোক বা সংস্থার পক্ষে দুইটি বিরাট দায়িত্ব অনির্দিষ্টকালের জন্য পালন করা কষ্টসাধ্য হইয়া পড়িবার কথা। … দেশের সংহতি ও শাসনকার্য পরিচালনা বিপন্ন হইয়া পড়ায় বর্তমানে সামরিক বাহিনী শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণে বাধ্য হইয়াছেন বটে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিবার জন্য যে বর্তমান শাসকরাই সচেষ্ট হইবেন তাহা একান্তভাবে স্বাভাবিক এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসিলেই যে তাঁহারা সামরিক শাসন প্রত্যাহার করিয়া লইবেন, তাহাও নিঃসন্দেহ।’ এভাবে তাঁর কলামে সুকৌশলে সামরিক শাসনের সমালোচনা আরম্ভ করা হলে ওই অভিযোগে তিনি ১৯৫৯ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেফতার হন।
মোসাফির তাঁর ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে কমিউনিস্টদের ‘লাল মিয়া’ আখ্যা দিয়ে সমালোচনা করতেন কিন্তু মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের তিনি ছিলেন আস্থাভাজন বন্ধু। স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে মানিক মিয়ার উদ্যোগেই বঙ্গবন্ধু ও কমিউনিস্টদের মধ্যে গোপন বৈঠক এবং সমঝোতা হয়। গবেষকদের মতে, মানিক মিয়া রাজনীতিক ছিলেন কিন্তু দলীয় রাজনীতি করেননি। তিনি গণতান্ত্রিক রাজনীতির জাতীয় ধারায় সম্পৃক্ত ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের দলগুলো তাঁর সমর্থন পেয়েছে। কিন্তু মোসাফির হিসেবে তার ভূমিকা ছিল দল নিরপেক্ষ কলামিস্টের বা সাংবাদিকের।
৭.
সাংবাদিকতা নিয়ে বেশ কিছু মতামত আছে মানিক মিয়ার। ষাটের দশকে রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে মানিক মিয়া বলেছিলেন, ‘সংবাদপত্র ব্যক্তিবিশেষের মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত হইলেও জনমতের প্রতিধ্বনি না করিলে সে পত্রিকা টিকিয়া থাকিতে পারে না, ইহা অন্যান্য ব্যক্তিগত সম্পত্তির ন্যায় ব্যবহার করা চলে না।’ স্বাধীন গণমাধ্যমের পক্ষে ছিল তাঁর অভিমতসমূহ। এজন্য সমকালীন সংবাদপত্রের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি উদ্বেগ নিয়ে বলেছেন, ‘বিংশ শতাব্দীর শেষ অর্ধশতকের নব্য স্বাধীন ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সবচাইতে বড় ট্র্যাজেডিই সম্ভবত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অপমৃত্যু অথবা মুমূর্ষু অবস্থা। এই অবস্থাকে বেশিদিন চলতে দেওয়া মানে একটি স্বাধীন জনসমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কাকে ত্বরান্বিত করা। তাই শুধু সংবাদপত্রসেবী হিসাবে নয়, সংবাদপত্রের পাঠক, বিপুলায়তনে জনসমাজের প্রতিনিধি হিসাবেও এ ভয়াবহ আশঙ্কাকে প্রতিরোধের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশেরই সচেতন নাগরিকদের সক্রিয় ও ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।’
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার পর যখন সরকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন মানিক মিয়া হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে ‘মোসাফির’ কলামে লিখেছেন, ‘যুক্তফ্রন্টের কর্মপন্থা কার্যকর করিতে টাকার প্রয়োজন নিঃসন্দেহে। কেন্দ্র ২/৪ কোটি দিলেও, না দিলেও, সেটা মূল সমস্যার সমাধান হতে পারে না। যক্ষ্মা রোগীকে যা খাওয়াইবেন, তা ক্ষয় হইয়া যাইবে। তাই প্রথমত ক্ষয় রোগের চিকিৎসা দরকার। পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদে কেহ হাত বসাইতে না পারে, সেটা দেখা হইবে যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রথম কর্তব্য। পাটের ফটকাবাজারি ব্যবসা বাণিজ্যে গোষ্ঠীবিশেষের মনোপলি, ভূমির উপর চাষীদের কর্তৃত্ব এবং কল-কারখানার মালিকদের অতিমুনাফা বজায় থাকিলে কোনো পরিকল্পনাই সফল হতে পারে না।’ তিনি দলকানা ছিলেন না; কিন্তু প্রকৃত বন্ধুর মতো সমালোচনা করে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন সরকারকে।
অন্যদিকে বন্যা মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে মুসলীম লীগ সরকারের সমালোচনা করেছেন এভাবে, ‘আমেরিকা টেনেলি নদীর বাঁধ নির্মাণ করিয়া দেশের সম্পদকে পূর্ণ ব্যবহার করিয়া শুধু বন্যা রোধ করে নাই বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং জমির ফলন বৃদ্ধি করিয়া দেশের সম্পদকে পূর্ণ ব্যবহার করিয়া আজ এতো বড় প্রতিপত্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত হইয়াছে। সেখানে গডের দুর্নাম কেউ শোনে না। আর আমরা যারা আল্লার খাশ বান্দা বলিয়া দাবি করি, তাদের এখানে দোষগুলি সব আল্লার, ভালো যেটুক, সেটুকু মুসলিম লীগের।… ব্যর্থতার বোঝা আল্লার ঘাড়ে আর ব্যর্থতার প্রতিবাদ করিলে আল্লার বান্দার উপর নামিয়া আসে ‘নিরাপত্তা আইন’ এইতো লীগের খেলা! আমি বিশ্বাস করি, পাকিস্তানে কোনো যোগ্য জনকল্যাণকর গণ-সরকার প্রতিষ্ঠিত হইলে এক বছরের মধ্যে প্রকৃতির এই ধ্বংসলীলা হইতে দেশকে রক্ষা করা যাইতে পারে।’
রাজনৈতিক দর্শন থাকার কারণে তিনি লিখেছেন- ‘মনে করিয়াছিলাম জনাব আলী গণতন্ত্রের পীঠভূমি মার্কিন রাজ্যফেরত; তিনি সসম্মানে সরিয়া দাঁড়াইবেন। ও-বাবা! সরিয়া দাঁড়ানো তো দূরের কথা তারা যে সার্বভৌম, অমরশীল এই জবর-থিওরি কপচাইতে শুরু করিলেন, নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হইয়াও তারা দুর্বল হইবার পরিবর্তে আরো যেন সবল হইয়া পড়িলেন। আইনের কী মারপ্যাঁচ। জনসাধারণের ভোট না পাইয়াও সর্বশক্তিমান। তা হইলে আর ভোটের জন্য মাঠে-ঘাটে দৌড়া-দৌড়ি করে কোন আহম্মক।’- সমকালীন প্রসঙ্গ হলেও চিরায়ত বক্তব্য এটি।
৮.
জাতির পথ নির্দেশদাতা ছিলেন মানিক মিয়া ওরফে মোসাফির নামক কলামিস্ট। এই কলামিস্টের একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল যদিও তিনি রাজনীতির মাঠে ছিলেন না। সেই দর্শন ছিল গণতন্ত্র ও স্বাধিকার অর্জনের আত্মত্যাগের দর্শন। তাঁর লিখিত কলামগুলো পড়লে দেখা যায়, তিনি সংবাদপত্রের সামাজিক দায়বদ্ধতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নীতি ও আদর্শ চেতনা দ্বারা পরিচালিত হতেন। তাঁর নিরপেক্ষ, মানবিক ও উদারদৃষ্টিভঙ্গি এবং অন্যায়ের প্রতিবাদ ছিল এদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে তাড়িত।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-writermiltonbiswas@gmail.com)