ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ারের বিশ বছরের পরিশ্রমের ফল ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’। তিনটি পর্ব ও একটি পরিশিষ্টসহ সর্বমোট ৮৯টি পরিচ্ছেদে পরিকল্পিত এ গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের অনন্য সংযোজন। ‘‘সামরিক সাহিত্য’’ বা মিলিটারি লিটারেচার বলতে যা বোঝানো হয় সেই ধারার রচনা এটি। কিন্তু কেবল বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে আখ্যান পল্লবিত হয়ে ওঠেনি এখানে। বরং শ্রমনিষ্ঠ গবেষকের অপরিসীম যত্ন রয়েছে প্রতিটি পর্ব কিংবা পরিচ্ছেদে। সামরিক সাহিত্যে সৈনিকদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যুদ্ধ, আবেগ-অনুভূতি ও আশা-আকাঙ্খা বা ভাবনার রূপায়ণ থাকে। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিকদের সেই ধরনের অভিজ্ঞতার বয়ান খুব বেশি একটা নেই। অন্যদিকে কিছু গ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধ কিংবা শান্তি মিশনের যুদ্ধে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের সেনাসদস্যদের দ্বারা লিখিত হলেও সাহিত্যের দিক থেকে সেসব রচনা এখনো পর্যন্ত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। সেদিক থেকে বায়েজিদ সরোয়ারের ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ গ্রন্থটি ব্যতিক্রম। ভূমিকায় তিনি যথার্থই লিখেছেন- ‘এই লেখায় কম্বোডিয়ায় আমার নানা অভিজ্ঞতা, শান্তিরক্ষীদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ইত্যাদি প্রকাশের চেষ্টা করেছি। একটি দেশের যুদ্ধ থেকে শান্তির পথে উত্তরণের চালচিত্র তুলে ধরেছি। এটি মূলত এক শান্তিরক্ষীর ডায়েরি বা নোটবই যেখানে একজন তরুণ শান্তিরক্ষীর ভাবনা, আশা-নিরাশা, কর্মক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ, আবেগ, অনুভূতি, স্বদেশ ভাবনা, রুটিন কাজ ও কাজের পরিবেশ প্রতিফলিত হয়েছে। এজন্য কোথাও কোথাও ঘটনার বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়।’(পৃ ১৯)
তবে বায়েজিদ সরোয়ার ঘটনার বিস্তৃত বিবরণের মধ্যে আবেগ ও অনুভূতির ফল্গুস্রোত প্রবাহিত করে দিয়েছেন। প্রতিটি অধ্যায়ের শুরুতে কবিতার স্তবকের প্রাসঙ্গিক ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কবি ও কবিতার বহুমাত্রিক প্রয়োগ লেখকের সাহিত্যপাঠের গভীরতারই পরিচায়ক। এছাড়া বিশ্বখ্যাত মন্দির প্রাঙ্গণ অ্যাংকর ওয়াটসহ বিচিত্র ঐতিহ্যের বৈভবময় বর্ণনা পাঠককে মুগ্ধ করে। বর্তমান বিশ্বের যুদ্ধ ও শান্তি অন্বেষণের জটিল পরিস্থিতিতে একদা ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি রাষ্ট্রের পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনী ব্যক্ত করেছেন তিনি। গ্রন্থটিতে একজন শান্তিসেনার জার্নালের ভঙ্গি সবসময় অক্ষুণ্ন থাকেনি। বরং দেখার অভিজ্ঞতা ও পাঠের গভীরতা লেখকের আবেগে সমর্পিত হয়ে সাবলীল গদ্যরীতি সৃজন করেছে। ভাষার ক্ষেত্রে যত্নবান এই লেখক বর্ণনা শুরু করেছেন বর্তমান কালে কিন্তু কথা বলছেন বিশ বছর আগে ঘটে যাওয়া অতীতের প্রেক্ষাপটে। এজন্য কখনো তিনি ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেছেন কম্বোডিয়া থেকে চট্টগ্রামে, কখনো আবার কম্বোডিয়ার সুপ্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে ভারতের তুলনা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে উপমহাদেশের কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশে অতীতে বিস্তার লাভ করে এখনো মানুষকে একই বন্ধনে আবদ্ধ রেখেছে। দীর্ঘকালের এক সাংস্কৃতিক বন্ধন আবিষ্কার করে লেখক নিজেও আশ্চর্যান্বিত হয়েছেন। একদিকে মুগ্ধতার আবেশ, অন্যদিকে শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মেলবন্ধন ঘটেছে ইতিহাসের শুষ্ক পৃষ্ঠা থেকে বাস্তবতার কঠিন সোপানে।
প্রকৃতপক্ষে ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ গ্রন্থটি কম্বোডিয়া নামক দেশের পরিচয়ে সমৃদ্ধ। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সবুজ প্রাঙ্গণ ও মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা এবং আনন্দের অফুরন্ত উপকরণে ঋদ্ধ প্রতিটি পৃষ্ঠা। ‘শান্তি’ নামক শ্বেত কপোতের ডানা মেলার আকাঙ্খায় উদ্দীপিত কম্বোডিও জনতার পাশে দাঁড়ানো লেখকের মতো শান্তিসেনাদের নিরলস প্রচেষ্টা, আত্মত্যাগ, পরিজনহীন পরিবেশে দিনের পর দিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার চিত্র, কখনও ছোট ছোট ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় উন্মোচিত মানুষের কথা দরদ দিয়ে বর্ণিত হয়েছে এ গ্রন্থে। খেমারুজ গেরিলাদের নৃশংস গণহত্যা আর ‘টুয়োল স্লেং জাদুঘরে’ রক্ষিত মাথার খুলি দিয়ে বানানো দেশটির মানচিত্রের বিবরণ পড়লে জাতিগতভাবে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব জটিল এক নির্মম রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায়। আর এসব থেকে উত্তরণের কথাই বলেছেন লেখক। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ গ্রন্থের পরিশিষ্টে বিস্তৃত পরিসরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বিশেষত শান্তিরক্ষা মিশনের উপর লেখা বইয়ের যে তালিকা দিয়েছেন আলোচ্য গ্রন্থটি ছাড়া অন্যগুলোর কোনোটাতে এতো বিস্তারিতভাবে এ বিষয়ে আলোচনা লিপিবদ্ধ হতে দেখা যায়নি। বায়েজিদ সরোয়ারের লেখা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, জাতিসংঘ সনদের ষষ্ঠ অধ্যায়ে আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা এবং সপ্তম অধ্যায়ে শান্তি প্রয়োগের বিধান রয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সংঘর্ষে লিপ্ত দুপক্ষের সম্মতি এবং মতৈক্যের উপর ভিত্তি করে শুরু হয়। শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ কর্তৃক অনুমোদিত একটি শান্তি চুক্তি বা শান্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মোতায়েন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতিসংঘের বিশ্বস্ত ও পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কারণ বিশ্বের সকল প্রান্তের দুর্গত, নিপীড়িত ও নিরীহ মানুষের সেবায় এ শান্তিরক্ষীদের হাত সর্বদা প্রসারিত। সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়েও তারা আর্তমানবতার সেবা করে চলেছে। আধুনিক কম্বোডিয়ার বিবরণ দিয়ে সেখানে শান্তি স্থাপনে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ তুলে ধরেছেন বায়েজিদ সরোয়ার। এছাড়া শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে গণমাধ্যমের ভূমিকার কথাও লিখেছেন। দেশ-বিদেশের একাধিক সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি কম্বোডিয়ার সবুজ প্রান্তরে হেঁটেছেন। অনুষ্ঠান কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় শরিক হয়েছেন। আসলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচিত্ররকম আবহাওয়ায় আমাদের শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘের মিশনে অংশগ্রহণ করছে। হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ এলাকায় তাদের পদচারণা। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহনীয় গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সাথে মানিয়ে নিয়ে রাত-দিনের দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠার পরিচয় দিয়ে চলেছে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী। বিশ্ব মানবতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীর রয়েছে অসামান্য অবদান। কারণ ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী রয়েছে; রয়েছে বিচিত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ। এসব সামাজিক ভেদাভেদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে সকলকে নিয়ে সহাবস্থান নিশ্চিত করছে শান্তিরক্ষীরা। কম্বোডিয়ায় একই কাজ করতে হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থের লেখকসহ অন্যদের। সেখানকার বিশৃঙ্খল এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করে শান্তি স্থাপনে সাফল্য অর্জন করেছেন তাঁরা। আসলে শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশী সদস্যদের অংশগ্রহণ ছিল একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কম্বোডিয়ার আবহাওয়া, নিসর্গ, চাঁদনী রাতের আবেষ্টনী লেখককে প্রাণিত করে। নিজের পর্যবেক্ষণ ও শান্তি স্থাপনে অন্যদের ভূমিকার মূল্যায়ন উপস্থাপন করেছেন লেখক।
তিন.
‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ বইটি স্বতন্ত্র কেন? পূর্বে কিছু ইঙ্গিত দিলেও বিষয়টি আরো বিস্তৃত ব্যাখ্যার দাবি রাখে। ‘গ্রন্থপঞ্জি’তে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো : বায়েজিদ সরোয়ার বাংলাদেশের শান্তিসেনা কর্তৃক রচিত বেশ কিছু গ্রন্থের উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেসব গ্রন্থ তাঁর মতো দীর্ঘ সময় এবং ব্যাপক আয়োজনে লিখিত নয়। বিশেষত লেখকের স্মৃতিময় কম্বোডিয়ার জীবন ও অভিজ্ঞতা এ গ্রন্থে অসাধারণ সাহিত্যগুণমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। আনটাক (ইউনাইটেড নেশনস ট্রানজিশনাল অথরিটি ইন কম্বোডিয়া) মিশনে ১৯৯২-৯৩ সালে তিনি একজন শান্তিরক্ষী (সামরিক পর্যবেক্ষক) হিসেবে কম্বোডিয়ায় গৃহযুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব পালন করেন। সেসময় দুজন নারী সদস্যসহ ১৩০৫ জন বাংলাদেশী শান্তিমিশনে অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষীদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে সেখানকার বৃহৎ ও জটিল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হন। কম্বোডিয়ার শান্তিরক্ষী বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে সেখানকার মানুষের দুঃখকষ্ট তরুণ বায়েজিদ সরোয়ারের মনকে ব্যথিত করে তুলেছিল।
তিনি ৭৫৯ নং পৃষ্ঠায় শান্তিরক্ষা মিশনের উপর লেখা বইয়ের একটি তালিকা দিয়েছেন। সেখানে ৩৬টি গ্রন্থে জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা, স্বেচ্ছাসেবক ও মিশন এলাকায় ভ্রমণকারী লেখক-সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা বেশ কিছু প্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু এসব লেখকের লেখায় ওইসব দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, দ্বন্দ্ব, যুদ্ধসহ নানা বিষয় উপস্থাপিত হলেও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ারের ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ গ্রন্থটি বেশ কিছু কারণে আলাদা। কারণ এ গ্রন্থের ভেতর দিয়ে তিনি একটি বক্তব্য তুলে ধরেছেন। শান্তিরক্ষী হিসেবে তিনি দেখেছেন গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত ও খেমারুজ বাহিনীর গণহত্যায় বিপর্যস্ত কম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেকার অনৈক্য এবং বিভেদে জর্জরিত বাস্তবতা। গ্রন্থটির সমস্ত বিবরণজুড়ে রয়েছে লেখকের এই মতের বিচ্ছুরণ, ‘‘ঐক্যবদ্ধ জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি অনিবার্য। আর জাতিগত বিভক্তি বয়ে আনে ধ্বংস। কম্বোডিয়াই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ।’’(পৃ ৫৮)
মূলত ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ গ্রন্থটি রচনার সার্থকতা এখানেই, গ্রন্থটি যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজ দেশে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় রাজনীতিবিদদের উৎসাহী এবং আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের সমৃদ্ধিকে জানতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে একজন সেনাসদস্যের লেখনি ও পঠন-পাঠনের পরিচয় পাঠকের কাছে উন্মোচিত হবে। কারণ সশস্ত্র ও পোশাকি সেনার মনের নানাকৌণিক প্রকাশ ঘটেছে এই গ্রন্থে। সহজ-সরল কিন্তু কাব্যিক অভিব্যঞ্জনায় ‘কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল’ সত্যিই অনন্য। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কাম্য।
কম্বোডিয়া : শান্তিসেনার জার্নাল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো : বায়েজিদ সরোয়ার, প্রচ্ছদ : দেওয়ান আতিকুর রহমান, প্রকৃতি, ২০১৬, পৃষ্ঠা : ৮০০, মূল্য : ৮৫০ টাকা।