বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা নামক মহাকাব্যের ‘মহাকবি’, তিনি বিশ্ব মিডিয়ার দৃষ্টিতে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’। তিনি ১৭ মার্চ ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর ছিল দুর্নিবার গ্রন্থপ্রীতি। তিনি ছিলেন সচেতন পাঠক। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, উইনস্টন চার্চিল, আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা, জন এফ কেনেডি, ফিদেল কাস্ত্রো প্রমুখ রাজনৈতিক নেতার মতো যখনই অবসর পেতেন, তখনই তিনি বইয়ের বিচিত্র জগতে হারিয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধু যে প্রচুর শিল্প-সাহিত্যের বই পড়তেন, তা তাঁর ভাষণ, বক্তৃতা, চিঠিপত্র আর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকেই প্রমাণ পাওয়া যায়। তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রবার্ট পেইন দেখেছেন, জর্জ বার্নার্ডশ, বার্ট্রান্ড রাসেলের রচনাবলি, মাও সেতুং স্বাক্ষরিত গ্রন্থ। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেমী ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৪৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণকালে একই গাড়িতে করাচি আসার পথে উর্দুভাষী কয়েকজন পাকিস্তানিকে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ২১৭) ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে চীনের শান্তি সম্মেলনে যোগদান করে তিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেছিলেন। (‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, পৃ. ২২৮)
১৯৪৮ থেকে ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকদের রুদ্ররোষে ২৪টি মামলায় ১৮ বার জেলে নিক্ষিপ্ত হন শেখ মুজিব। তিনি সর্বমোট ১২ বছর জেল খেটেছেন। আর ১০ বছর কড়া নজরদারিতে ছিলেন। জেলবন্দি নিঃসঙ্গ জীবনেও বই ছিল তাঁর একমাত্র অবলম্বন। ২১ ডিসেম্বর, ১৯৫০ সালে ফরিদপুর ডিস্ট্রিক্ট জেল থেকে বঙ্গবন্ধু একটি চিঠি লিখেছিলেন গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে। সেই চিঠিটি তৎকালীন সরকার বাজেয়াপ্ত করলেও গবেষকরা পরবর্তী সময় উদ্ধার করেন। সেই চিঠিতে আছে : Last October when we met in the Dacca Central Jail gate, you kindly promised to send some books for me. I have not yet received any book. You should not forget that I am alone and books are the only companion of mine. (নিরীক্ষা, জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১২, প্রেস ইনস্টিটিউট, ঢাকা)
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল, যা সব সময় আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু আমার মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র-রচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নার্ডশর কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলোতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মা’র সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বইকেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলো ওরা (পাকিস্তানিরা) নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল, কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ (শেখ হাসিনা : শেখ মুজিব আমার পিতা, আগামী প্রকাশনী, ২০১৪, পৃ. ৭০-৭১)
খ.
বঙ্গবন্ধু একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে কেবল সাধারণ মানুষ কিংবা কৃষক-শ্রমিকদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি। স্বাভাবিকভাবে স্বীয় শ্রেণির শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তা ছাড়া আগেই বলা হয়েছে, তিনি সাহিত্যের একজন অনুরাগী পাঠক ছিলেন। ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি বলেন, ‘শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকবৃন্দের সৃষ্টিশীল বিকাশের যে-কোনো অন্তরায় আমি এবং আমার দল প্রতিহত করবে।’ (আতিউর রহমান, ‘বাঙালি সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বঙ্গবন্ধু’, শোকাশ্রু, বঙ্গবন্ধু সমাজকল্যাণ পরিষদ, ২০১৫, পৃ. ৩০) ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পরপরই বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে অনুরোধ করে ঢাকায় নেন। ১৯৭২ সালের ২৫ মে ঢাকায় কবির বাসায় যাওয়ার সময় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর থেকে বের হয়ে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা আবৃত্তি করতে করতে পথ হেঁটেছেন বঙ্গবন্ধু। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র সূত্র অনুযায়ী আব্বাসউদ্দীনের ভাটিয়ালি গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। এই কণ্ঠশিল্পীর বাংলা ভাষা রক্ষার আকুতিতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে অবদান রাখেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী হয়েও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতেন। প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘এ দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেদের লেখনীর মধ্যে নির্ভয়ে এগিয়ে আসুন, দুঃখী মানুষের সংগ্রাম নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করুন। কেউ আপনাদের বাধা দিতে সাহস করবে না।’ (দৈনিক ইত্তেফাক ১৬/২/১৯৭১) তার আগে ৯ জুন ১৯৬৯ সালে বাংলার সবচাইতে জনপ্রিয় সাংবাদিক ‘মানিক ভাই’ প্রবন্ধে শেখ মুজিবুর রহমান লেখেন, ‘তিনি ছিলেন এক সার্বক্ষণিক প্রেরণা। অতি বড় দুর্দিনেও তাঁর উপর আমরা ভরসা রাখতে পেরেছি। কাছে গিয়ে সাহস ফিরে পেয়েছি। তিনি নিষ্ঠাবান সংগ্রামী ছিলেন। সংগ্রামীদেরকে তিনি ভালোবাসতেন।’(বঙ্গবন্ধু ও গণমাধ্যম, সম্পাদক ড. মোহাম্মদ হাননান, পৃ ১৩) বেবী মওদুদ লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধকালে ক্ষতিগ্রস্ত দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুটিকে বিজয় লাভের পর পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড় করাতে সবরকম সহযোগিতা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।’ (সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও শেখ মুজিব, নিরীক্ষা, জুলাই-আগস্ট ২০১৩) বঙ্গবন্ধুর শতাব্দীতে কয়েকটি দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদও ছিলেন কোনো না কোনো পত্রিকা বা রাজনৈতিক সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত। মহাত্মা গান্ধী নিউ ইন্ডিয়া, মতিলাল নেহরু ইনডিপেনডেন্ট, মাওলানা মোহাম্মদ আলী কমরেড, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বেঙ্গলি, জওহরলাল নেহরু ন্যাশনাল হেরাল্ড, অরবিন্দ ঘোষ বন্দেমাতরম, সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড, বিপিন চন্দ্র পাল ইয়ং ইন্ডিয়া, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নারায়ণ, ফজলুল হক কৃষক ও নবশক্তি পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন নতুন দিন, ইত্তেহাদ, ইত্তেফাক, মিল্লাতসহ কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সব সময়ই কাছে পেয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের। জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, হাশেম খান, সমরজিৎ রায়চৌধুরী প্রমুখ কবি ও চিত্রশিল্পী এবং কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক ছবি রয়েছে। ১৯৭৩ সালে ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পীদের মাঝেও তাঁকে দেখা গেছে। ১৯৭৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘মানবাত্মার সুদক্ষ প্রকৌশলী হচ্ছেন দেশের সুধী সাহিত্যিক, শিল্পী, শিক্ষাব্রতী, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী।’ এ জন্য তাঁদের প্রতি তাঁর প্রাণের টান এত। অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্মৃতিচারণ-এ আছে, ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মন্মথ রায়কে বাম পার্শ্বে ও তাঁকে দক্ষিণ পার্শ্বে বসিয়ে সেদিন নানা অন্তরঙ্গ কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি অসুস্থ কবি হুমায়ূন কাদির, আবুল হাসান ও মহাদেব সাহাকে সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন, মস্কো, লন্ডন প্রেরণ করেন এবং একটি কবিতা লেখার জন্য দাউদ হায়দারকে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা এবং নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। কবি আল মাহমুদকে জেল থেকে মুক্ত করে শিল্পকলা একাডেমিতে নিয়োগ প্রদান করেন। তিনি ছিলেন নাটকের একজন সুহৃদ। টেলিভিশন ও মঞ্চনাটকের ওপর থেকে প্রমোদকর ও সেন্সর প্রথা সহজতর করেছিলেন নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তাঁর অবদান ছিল। প্রাদেশিক পরিষদে এফডিসির বিল উত্থাপন করেন বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল। তখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ছিল চলচ্চিত্রবিষয়ক দপ্তর। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’ প্রদান করা হয় বাংলাদেশের ১৮ এবং ভারতের চারজন বিশিষ্ট শিল্পী, সংস্কৃতিসেবী ও বেতারকর্মীকে। অর্থাৎ কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়নে তিনি যুক্ত করেছিলেন শিক্ষক-প্রকৌশলী ও পেশাজীবীদের, শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রশাসনের সঙ্গে রেখেছিলেন।
গ.
রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্থ ছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির ভাষণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার পঙক্তি, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী,/রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করনি’ এবং ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেছেন। ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি’ এবং ‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস’ তাঁর কণ্ঠে সেদিন উচ্চারিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনে রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছিল বেশি। তাঁর অন্তর দখল করে রেখেছিলেন বিশ্বকবি। রাজনৈতিক জীবনে দুঃখ-দৈন্য-সংকটে আবৃত্তি করতেন, ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা’ কিংবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে…’ বহুল পরিচিত চরণসমূহ। জেলে যাওয়ার সময় ‘সঞ্চয়িতা’ হাতে তুলে নিতেন। বোঝা যায় একমাত্র সঙ্গী বা অনুপ্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা একাডেমি আয়োজিত ১৯৭২ সালের ৮ মে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীতে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে লক্ষ লক্ষ প্রাণ ও অপরিমেয় ত্যাগের বিনিময়ে। কিন্তু সত্য, শ্রেয়, ন্যায় ও স্বাজাত্যের যে চেতনা বাঙালি কবিগুরুর কাছ থেকে লাভ করেছেন, আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে তারও অবদান অনেকখানি। বাঙালির সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। বাঙালির রবীন্দ্র-সম্মাননার চেয়ে বড় কোনো দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।’
প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তিনি গভীর মনোযোগসহকারে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে সকালের নাশতা সারতেন। এক স্মৃতিচারণে মাহবুব তালুকদার টুঙ্গিপাড়ার সফরসঙ্গী হিসেবে সকালে ঘুম থেকে উঠে বঙ্গবন্ধুকে নৌযানে বসে নদীর দুই পাড়ের গ্রামবাংলার দৃশ্য দেখে আবৃত্তি করতে শুনেছিলেন, ‘নম নম নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি/গঙ্গার তীর, স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি’ রবীন্দ্র পঙক্তিমালা। জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি ১৯৫৬ সাল থেকেই তাঁর প্ররোচণায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে ঠিক করে ফেলেন সোনার বাংলা গড়ার। গানটি সর্বত্র প্রচারে শেখ মুজিবের সক্রিয় ভূমিকার কথা জানিয়েছেন প্রফেসর ড. সন্জীদা খাতুন। (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ মে ২০০৫)
ঘ.
অর্থাৎ ওপরের বিবরণ থেকে আমরা বুঝতে পারছি, শিল্প-সংস্কৃতির একজন রসবোদ্ধা হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেশ-বিদেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীদের গভীর সম্পর্ক ছিল। এ জন্য ১৫ আগস্টের (১৯৭৫) হত্যাকাণ্ড রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সঙ্গে অভিঘাত রাখে শিল্পী-সাহিত্যিক ও কবিদের চেতনায়। পরে তাঁরা তাঁদের লেখনীতে সামাজিক দায়িত্ব পালন করেন। মূলত জাতিকে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে প্রেরণা জুগিয়েছেন শিল্প-সাহিত্য সমাজের ব্যক্তিবর্গ।
বঙ্গবন্ধুর শিল্পসংস্কৃতি ভাবনায় দুঃখী মানুষের কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। লোকজ সংস্কৃতির প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল বিস্তর। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সোনারগাঁয় ‘বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন’ স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায়। ১৯৭২ সালের ১-৫ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরকালে সেখানকার নেতৃবৃন্দের জন্য উপহার হিসেবে তিনি নিয়ে যান কচি-কাঁচার মেলার শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম। রাজনীতি করে যেমন গরিব কৃষক ও শ্রমিকের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন, তেমনি শিল্প-সংস্কৃতির চেতনাসম্পন্ন উপযুক্ত জাতি গঠনে নিবেদিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
রাজনীতির অমর কবি বঙ্গবন্ধুর মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার অঙ্গীকার পরবর্তীকালে দেশের শিল্পী-সাহিত্যিকরা ভুলতে পারেননি। দেশ পরিচালনায় খুব কম সময় পেলেও তাঁর আত্মবলীদান প্রেরণার শতধারায় উৎসারিত এখনো। তাঁকে আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী করে তুলেছেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা—সৃষ্টি হয়েছে কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, চিত্রকলা। আদর্শের মৃত্যু নেই, যেমন কবি পাবলো নেরুদা লিখেছেন, ‘কোনো কোনো রক্তের দাগ কিছুতেই শুকোবার নয়।’ বঙ্গবন্ধুর রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি। প্রেরণার উৎসে মহীরুহ তিনি। এ জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের জাগরণ হলো। বিনা দ্বিধায় আমরাও বলে উঠলাম, ওই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যত দিন লড়াই চলবে, তত দিন আমরাও সঙ্গে আছি। বাঙালি হিসেবে আমরাও সহযোদ্ধা।’ (আমরা কি বাঙালি, পত্রভারতী, কলকাতা, পৃ. ১৪৩) ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দেওয়া মন্মথ রায় লেখেন (আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন স্মরণিকা) ‘বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অবলম্বনে লিখিত আমার দুইটি নাটক এক. স্বাধীনতার ইতিহাস, দুই. আমি মুজিব নই গ্রন্থ দুইটি তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে ধন্য হতে পেরেছিলাম।’
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির ১০ ধারায় মৃত ব্যক্তির মাহাত্ম্য প্রচার নিষিদ্ধ করে এক ঘোষণা দেওয়া হয়। ফলে ২১ বছর ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৯৬ থেকে পুনরায় ব্যবহৃত হতে থাকে শব্দটি; শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার যুগ শুরু হয়।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email- writermiltonbiswas@gmail.com)