মঙ্গলবার, রাত ১১:১২ ৩রা ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে প্রচার-অপপ্রচার
/ ৭১৫ বার
আপডেট : মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

২২ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনগণ ভালো থাকলে কিছু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। দেশে যদি কোন মার্শাল ল জারি হয়, অসাংবিধানিক শক্তি ক্ষমতা দখল করে, তখন তারা খুব শান্তিতে থাকে। কারণ তারা ক্ষমতার বাতাস পায়। সে আশায় তারা জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।’ প্রধানমন্ত্রীর কথার সূত্র ধরে বলতে হয় জনগণের ভাগ্য নিয়ে ভয়ঙ্কর ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন তিনি দ্বিতীয় মেয়াদের সরকারপ্রধান হিসেবে দেড় মাস সময় অতিবাহিত করেছেন, ঠিক তখন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে সরকার-সেনাবাহিনী সম্পর্ক তিক্ত করে ফেলার চেষ্টা এবং বিডিআর জওয়ানদের বিদ্রোহের আগুন সেনাবাহিনীর জওয়ানদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার টার্গেট নেওয়া হয়। সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। কিন্তু ওই নির্মম ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রচার এবং অপপ্রচার চলতে থাকে দেশ-বিদেশে।

২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারি রাজধানীর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘অন্তরজ্বালা’ থেকে ‘বিভ্রান্তিমূলক মিথ্যা তথ্য’ দিয়ে জনমনে ‘অস্বস্তি সৃষ্টির’ চেষ্টা চালাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। ওইদিন তিনি পিলখানা হত্যাযজ্ঞ এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার নিয়ে কথা বলেন; বিডিআর বিদ্রোহে খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া জড়িত বলে তার সন্দেহের কথাও জানান। বিডিআর বিদ্রোহের দিন লন্ডন থেকে তারেক রহমান ফোন করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ছাড়তে বলেছিলেন। বিদ্রোহ শুরুর আগেই খালেদা জিয়া সকালে বাড়ি ছাড়েন। আর তারেক রহমান লন্ডন সময় রাত ১টায় (বাংলাদেশ সময় সকাল ৭টা) ৪৫ বার ফোন করেন। শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ওই দিনের ঘটনা দেখে প্রতীয়মান হয়, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে খালেদা জিয়ার যোগসূত্র ছিল। অথচ খালেদা জিয়া তার ভাষণে দোষারোপ করেন বিডিআর বিদ্রোহ নাকি আওয়ামী লীগই করেছে। এভাবে খালেদা জিয়া আর তাদের সমর্থকরা দীর্ঘ ১০ বছর ধরে পিলখানা হত্যাযজ্ঞ নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন।

২.

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় দরবার শুরু হওয়ার মাত্র ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় গুলি হয়। গুলির পরই দরবার হলে ছুটোছুটি এবং পিলখানার অভ্যন্তরে একমাত্র দক্ষিণ দিক ছাড়া পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে গোলাগুলি শুরু হয়ে যায়। বিডিআর জোয়ানরা একে অপরকে বলতে থাকে অফিসারদের ‘ধর’। এভাবে শুরু তারপর একে একে ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাকে বীভৎসভাবে হত্যা করা হয়। সব মিলে ৭৪ জন মানুষকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল সেদিন। ঘটনার নেপথ্যে কারা ছিল সে সম্পর্কে ২০১৩ সালে ঘোষিত বিচারের রায়ে স্পষ্ট করা হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ ওই বিচার প্রক্রিয়ার রায়ে ১৫২ জনের ফাঁসি হয়েছে। বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুসহ ১৬১ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আদেশ হয়েছে ২৬২ জনের। আবার রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হওয়ায় খালাস পেয়েছে ২৭১ জন। সুশৃঙ্খল একটি বাহিনীর অপরাধী সদস্যদের বিচার শেষ করার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কারণ জিয়ার শাসনামলে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত সংঘটিত ২১টি সামরিক অভ্যুত্থানে ১২০০-এর বেশি সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্য নিহত হলেও সেই অভ্যুত্থানের কোন দৃশ্যমান বিচার হয়নি। এমনকি অনেক মামলার নথিও গায়েব হয়ে গেছে। তাহলে পিলখানা হত্যাকান্ড নিয়ে বিএনপি-জামায়াত ঘরানার মানুষের অপপ্রচারের উদ্দেশ্য কি? অন্যদিকে শেখ হাসিনা সরকার সেই ঘটনায় নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের পুনর্বাসনে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়ে নানাবিধ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন। কেবল আর্থিক অনুদান নয় ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর করে নির্বাহের জন্য সকল ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে।

পিলখানা হত্যাকান্ডে শহীদ অফিসারদের পরিবারবর্গকে গত ১০ বছরে দেয়া হয়েছে আর্থিক অনুদান ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধাসমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তরফ থেকে ৬১টি পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে অনুদান প্রদান। সব শহীদ পরিবার পেনশন কম্যুটেশন বেনিফিট প্রাপ্ত। সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল থেকে সব পরিবারকে ৫ লাখ টাকা করে অনুদান। উপরন্তু সেনাবাহিনী পরিবার নিরাপত্তা প্রকল্প তহবিল থেকে সব পরিবার ৮ লাখ টাকা (সৈনিক পরিবার ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা) করে পেয়েছেন। আবার বিডিআর তহবিল থেকে সব পরিবার (সৈনিক পরিবার ব্যতীত) ৫০ হাজার টাকা করে প্রাপ্ত হয়েছেন। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রত্যেক পরিবারকে (সৈনিক পরিবার ব্যতীত) মাসিক ৪০ হাজার টাকা করে (বাৎসরিক ৪ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা) ১০ বছর পর্যন্ত মোট ৪৮ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে। সৈনিক পরিবারকে সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল থেকে মাসিক ১০ হাজার টাকা করে (বাৎসরিক ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা) মোট ১০ বছর পর্যন্ত ১২ লাখ টাকা অনুদান দেয়া হয়েছে। ২ লাখ টাকার ট্রাস্ট ব্যাংক মিউচুয়াল ফান্ড প্লেসমেন্ট শেয়ার গ্রহণ করেছেন ৫৬টি পরিবার। প্রত্যেক পরিবার সিএসডি থেকে এককালীন ২১ হাজার ৩ শত টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং সিএসডি ডিসকাউন্ট কার্ড পেয়েছেন।

শুধু আর্থিক সুবিধা নয় শহীদ পরিবারবর্গ অন্যান্য সুবিধাও প্রাপ্ত হয়েছেন। যেমন, শহীদ পরিবারের ৪ জন সদস্য ভর্তি/টিউশন ফি ব্যতীত বিভন্ন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছেন। সেনাবাহিনীর অধীন বিভিন্ন স্কুল/কলেজে অধ্যয়নরত শহীদ পরিবারের মোট ৪৫ জন শিশুর ভর্তি/টিউশন ফি মওকুফ করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর অধীন নয় এমন স্কুল/কলেজে অধ্যয়নরত (পিটারপেন, রাজউক, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল, শাহীন স্কুল) শহীদ পরিবারের মোট ৩২ জন শিশুরও ভর্তি/টিউশন ফি দিতে হয়নি। শহীদ পরিবারের মোট ১১ জন ছেলেমেয়ে বিভিন্ন ক্যাডেট কলেজে পড়ছে।

অসহায় পরিবারগুলোর জন্য আবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। কেবল আবাসন নয়, চাকরি এবং স্বাস্থ্য সেবাও দরকার ছিল তাদের। এজন্যই ৪৬টি আগ্রহী শহীদ পরিবারকে বিভিন্ন সেনানিবাসে সরকারি বাসস্থানে অবস্থানের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, যার মধ্যে ১০টি শহীদ পরিবার অদ্যাবধি সেনানিবাসে (সরকারি বাসা, স্বপ্নচূড়া অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে) বসবাস করছেন। মোট ৬০টি পরিবারের মধ্যে (১ জন অবসরপ্রাপ্তসহ) ১২ জন অফিসার পূর্বেই ডিওএইচএস/রাজউকের প্লট পেয়েছিলেন। বাকি ৪৭ জনকে চাকরির মেয়াদ বিবেচনায় প্লট/ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে- যেমন, ৩৮টি শহীদ পরিবারকে ডিওএইচএস মিরপুর, মহাখালী ও চট্টগ্রামে প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ৬টি শহীদ পরিবারকে ডিওএইচএস মিরপুরে ২টি করে ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে (১৮ বছর চাকরি পূর্ণ না হওয়ায় প্লট প্রাপ্ত হননি)। ৪টি শহীদ পরিবার যারা পুনর্বিবাহ করেছেন তাদের ডিওএইচএস মিরপুর ১টি করে ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে (১৮ বছর চাকরি পূর্ণ না হওয়ায় প্লট প্রাপ্ত হননি)। সৈনিক পরিবারকে সাভার খেজুর টেক সেনা পল্লী আবাসন প্রকল্পে ১টি ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে। সব শহীদ পরিবারকে এএইচএস এ প্লট (সৈনিক পরিবার ব্যতীত) প্রদান করা হয়েছে যা, ডিওএইচএস এ প্লট প্রাপ্তির অতিরিক্ত। শহীদ একজন সৈনিকের পরিবারকে সাভার খেজুরটেক সেনাপল্লী আবাসন প্রকল্পে বিনা মূল্যে ১টি ফ্ল্যাট প্রদান করা হয়েছে। মোট ৩১ জন শহীদ পরিবারের সদস্যকে বিভিন্ন চাকরি দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে তিনজন বিদেশে চাকরি পেয়েছেন (২ জন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং একজন অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন)। সব শহীদ পরিবার সিএমএইচ এ বিনামূল্যে চিকিৎসা পাচ্ছেন।

সব শহীদ পরিবারের সেনানিবাসের বাসায় সামরিক টেলিফোন সংযোগ প্রদান ও ১৫টি শহীদ পরিবারের হাউজ বিল্ডিং লোন (মূলসহ) মওকুফ এবং সেনানিবাসে অবস্থানরত সকল শহীদ পরিবারকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দুগ্ধ কার্ড এবং ঘি প্রদান করা হয়েছে। ৩টি শহীদ পরিবারের কম্পিউটার লোন মওকুফ এবং আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য ০৫ (পাঁচ) জন শহীদ অফিসারের পিতা/মাতাকে সেনাবাহিনী কল্যাণ তহবিল হতে ২০১৬ সালে ১৫ লাখ টাকা করে প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানেও শহীদ পরিবারবর্গকে চাহিদা অনুযায়ী প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তবু থেমে নেই সরকার বিরোধীদের অপপ্রচার।

৩.

শহীদ পরিবারগুলোকে আওয়ামী লীগ সরকারের তরফ থেকে সাধ্যমতো সহায়তা করা এবং পুনর্গঠিত ‘বিজিবি’ ঢেলে সাজানো হলেও বিরোধী তথা পাকিস্তানি দালালদের নানান অপপ্রচার এখনও সরব। একথা সত্য যে শেখ হাসিনা ওই হত্যাযজ্ঞ পরিস্থিতি সেদিন দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছিলেন। অপরাধীদের বিচারকার্য সম্পন্ন করে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে সম্মানিত করা হয়েছে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকারের নেতৃত্বে গণতন্ত্র নতুন করে বিকশিত হওয়ার সময় চক্রান্তকারীদের পিলখানা হত্যাযজ্ঞ দেশের ইতিহাসে মর্মন্তুদ ঘটনা। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৪৭ দিনের মাথায় এই বর্বরোচিত ঘটনা কিসের আলামত ছিল? সেনাবাহিনীর ৫৭ কর্মকর্তা হত্যার শিকার হবার পরেও গোটা ফোর্স ধৈর্য ধারণ করেছিল ন্যায় বিচারের অপেক্ষা করে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর এর চেয়ে বড় অবদান আর কি হতে পারে? মহাজোটের সেই আমলেই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আরও একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এসব শুধু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা থেকেই সম্ভব হয়েছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ বিডিআরদের উদ্দেশ্যে তাকে বলতে শোনা যায়- ‘আপনারা জানেন, গতকাল (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকার পিলখানায় বিডিআর সদর দফতরে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমি অত্যন্ত মর্মাহত। আত্মঘাতী এই হানাহানিতে জীবন দিতে হয় আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তা, বিডিআর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিকদের। এ প্রাণহানির ঘটনায় আমি দারুণভাবে মর্মাহত এবং দুঃখিত। আমি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তাদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানাই। আমার প্রশ্ন, কার বুকে গুলি চালাবেন? তারা তো আপনারই ভাই। ভাই হয়ে ভাইয়ের বুকে গুলি করবেন না। আপনার বোনকে বিধবা করবেন না। আমরা আপনাদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। অত্যন্ত ধৈর্য সহকারে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি। আপনারা আমাকে সাহায্য করুন। এমন পথ নেবেন না যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। আমাকে দেশের স্বার্থে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বাধ্য করবেন না। মনে রাখবেন, সংঘাত আরও সংঘাত বাড়ায়। আপনারা সংযত হোন। অস্ত্র সমর্পণ করুন। আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না, আমি আশ্বস্ত করছি।’

প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের পুরো ভাষণজুড়ে ছড়িয়ে আছে নিহতদের জন্য শোক আর তাদের স্বজনদের জন্য কাতরতা। ভাষণটির শেষাংশে তিনি বিডিআর হানাদারদের কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ারি প্রদান করেছেন যেমন, তেমনি বারবার সেনা পরিবারের ক্ষতির কথা স্মরণ করেছেন। এর চেয়ে মানবিক দলিল আর কি হতে পারে? ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে পিলখানার তা-বের খবর পেয়ে তিনি সংকট সমাধানে নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার সদস্য, নিজের দল ও মহাজোটের নেতৃবৃন্দ, তিন বাহিনী প্রধান, পুলিশের আইজি, র‌্যাবের ডিজিসহ আরও অনেকের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। সবার পরামর্শের ভিত্তিতেই সামরিক অভিযানের পরিবর্তে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজমকে পিলখানায় প্রেরণ করা হয়। তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নেত্রীর নির্দেশে সংকট নিরসনে প্রচেষ্টা চালান। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনসহ আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের বেশ কয়েকজন নেতা বর্বর বিডিআর জওয়ানদের ভয়ে ভীত না হয়ে পিলখানায় ঢুকে জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করেন সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারদের। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, কৌশল ও দূরদর্শী নেতৃত্ব, সশস্ত্র বাহিনী প্রধানদের আন্তরিক সহযোগিতায় অবসান ঘটে তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের। ২০০৯ সালের ১ মার্চ সেনাকুঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সেনা কর্মকর্তাদের সভা ছিল সব সন্দেহ-বিভ্রান্তি দূর করার প্রচেষ্টার অংশ। একটি সুপরিকল্পিত পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের পরে সেনাবাহিনী ক্রোধ প্রকাশ থেকে বিরত থেকেছেন; প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠেননি। সেনাপ্রধানসহ তিন বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের ভূমিকা এজন্য দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে।

পক্ষান্তরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পিলখানায় সেনা সদস্য ও তাদের পরিবার-পরিজন আটক থাকা অবস্থায় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে কৌশলগত বিরাট ভুল হয়েছিল বলে আমি মনে করি।’ তার অনুসারীরা একইভাবে সামরিক অভিযানের কথা উচ্চারণ করে থাকেন। অথচ পিলখানার ঘটনায় দেশজুড়ে এবং বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক যে অসন্তোষ ও অনৈক্য দেখা দিয়েছিল তা জাতীয় স্বার্থেই দ্রুত নিরসন করতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। উইকিলিকসে প্রকাশিত বাংলাদেশের তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টির পাঠান একটি বার্তায় তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্রোহীদের ওপর সামরিক আক্রমণ পরিচালনার নির্দেশ দেয়া সম্পর্কে বলা হয়- প্রধানমন্ত্রী সে রকম নির্দেশ দিলে আরও বেশি রক্তপাত হতো। তিনি লিখেছেন: ‘অধিকাংশ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে বিদ্রোহের শুরুতে; সংবাদমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক মহল মনে করে, আরও রক্তপাত যে এড়ানো গেছে, তার কৃতিত্ব হাসিনার।’ নৃশংস হত্যাকান্ডের দিন জোয়ানদের দখলে ছিল পিলখানায় বিপুল পরিমাণে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। ওইদিন ৩০-এর বেশি সেনা অফিসারের পরিবার অফিসার্স কোয়ার্টার এবং মেসে অবস্থান করছিলেন। তাদের সংখ্যা ছিল আনুমানিক দেড় শতাধিক। তাদের প্রায় সবাইকেই পরবর্তীতে কোয়ার্টার গার্ড এলাকায় বন্দি করে রাখা হয়। তাছাড়া ছিল বিডিআরের আনুমানিক ১০০ জন জেসিও এবং অন্যান্য পদবীর সদস্যদের ৫ শতাধিক পরিবার। পিলখানার পার্শ্ববর্তী এলাকার স্থাপনাগুলোও গুরুত্বপূর্ণ এবং ঘনবসতিপূর্ণ। ফলে হত্যাকারীদের প্রতিহতের জন্য সামরিক অভিযান হলে তা হতো অনেক হতাহতের কারণ। পিলখানার ভেতরের জীবিত সেনা অফিসার তাদের স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ হত্যাকান্ডের শিকার হতেন। ৩ মার্চ (২০০৯) সেনাবাহিনীর একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি পিলখানা বিডিআর সদর দফতরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে সেই বাস্তবতা স্পষ্ট উপলব্ধি করেছিলেন। অর্থাৎ শেখ হাসিনার নির্দেশনা নির্ভুল ছিল। আসলে পিলখানা হত্যাযজ্ঞের সেই দিনগুলোতে দৃঢ় মনোভাব ও প্রজ্ঞাম-িত দিক-নির্দেশনা এবং পরবর্তী সময়ে সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুৎসা রটনার সমুচিত জবাব দিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখে কালিমা লিপ্ত করেছেন শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরী শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের মৃত্যু প্রসঙ্গে ‘কিছু প্রাণী মারা গেছে’ বলে বিদ্রƒপ করেছিলেন। অপরদিকে অভিযুক্ত আসামিদের পক্ষে আইনি লড়াই করেছিলেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, খালেদা জিয়ার প্রধান উপদেষ্টা আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক প্রমুখ। এছাড়াও ছিলেন সাবেক ছাত্র শিবির নেতা অ্যাডভোকেট ফারুক আহমেদ। ছিলেন খালেদা জিয়ার আরেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মো. জয়নুল আবেদীনসহ আরও অনেকেই। হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ডিএডি তৌহিদ ও বিদ্রোহী সিপাহী মাঈনসহ আরও অনেকে। অভিযুক্তদের প্রায় সবাই বিএনপি আমলে নিয়োগ প্রাপ্ত। টাঙ্গাইল থেকে গ্রেফতার হওয়া ২২ জন বিডিআর সদস্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড মামলার আসামি বিএনপির উপমন্ত্রী সালাম পিন্টুর সুপারিশে চাকরি পেয়েছিল। এসব সত্ত্বেও শেখ হাসিনা সরকার বিদ্রোহে জড়িতদের শাস্তি দিতে পিছপা হয়নি। ঘটনার পরই এফবিআই ও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল।

৪.

২০০৯ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় যে নির্মম হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় তা নিয়ে গত এক দশক ধরে চলেছে বিচিত্র প্রচার এবং অপপ্রচার। পূর্বে উল্লিখিত বক্তব্যের সূত্র ধরে হত্যাকান্ড সম্পর্কে উইকিলিকসের প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণ এখানে উপস্থাপন করা যেতে পারে। তাদের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায় ‘পিলখানা হত্যাকান্ড’ ঘটে। এর মূল লক্ষ্য ছিল- তৎকালীন নতুন সরকার উৎখাত ও জঙ্গি বাহিনীর উত্থান এবং বিডিআর বাহিনী ধ্বংস করে দেয়া। বিএনপি জামায়াত সরকারের সহায়তায় যেভাবে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদ বাংলাদেশে বিস্তার করছিল তাতে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতা করেছিল বিএনপি এবং জামায়াত ইসলামের বেশকিছু সিনিয়র নেতৃবৃন্দ যার তদারকিতে ছিলেন তারেক জিয়া। ওই সময়ে তারেক জিয়ার সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রায় ২০০-রও বেশি ইমেইল আদান-প্রদানের রেকর্ড বিশ্লেষণে এসব তথ্যপ্রকাশ করে উইকিলিকস। সরকার পতনের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সময়টিকে বেছে নেয়া হয়Ñ যা ছিল শেখ হাসিনার নতুন সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর সম্পূর্ণ নাজুক সময়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বিডিআর সৈনিকদের দাবি-দাওয়ার আড়ালে মূল প্লানটি বাস্তবায়নের জন্য মোট ৬০ কোটি রুপি বরাদ্দ করে পাকিস্তান। এর মধ্যে পিলখানায় ১৫ থেকে ১৭ কোটি টাকা বিলি হয়, যাতে প্রতিটি অফিসারের মাথার বদলে ৪ লাখ টাকা ইনাম নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২৫ তারিখ সকালে বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টু পিলখানার ঢুকতে সহায়তা করে পাকিস্তানের ১৫ জন শুটারকে। পুরো পরিকল্পনা ও কলকাঠি ছিল তারেক জিয়ার হাতে। ঘটনার দিন সকাল থেকে বাংলাদেশে বিএনপি নেতাদের মালিকানাধীন মিডিয়া গুলো মনগড়া তথ্য দিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে থাকে। বিদ্রোহ শুরু হবার আগেই খালেদা জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় তারেক। সকাল বেলা খালেদা জিয়া ক্যান্টনমেন্টের বাসা ছেড়ে প্রথমে পাকিস্তান হাইকমিশনে যান এবং পরে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন। বিদ্রোহের দিন পাকিস্তানের বিমানবাহিনী বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাতে পূর্ণ সহায়তা দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল। ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর তথ্যানুযায়ী জানা যায় এ পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের আইএসআইয়ের। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী মিডিয়াকে বলেন, ‘এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তা দিতে ভারত প্রস্তুত।’ এসব তথ্যসূত্রের প্রচার অনুযায়ী বিডিআর কর্তৃক সেনা নিধনের ঘটনাটি ছিল সুপরিকল্পিত। বিডিআর জোয়ানদের মধ্যে ডাল-ভাত কর্মসূচি নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ ছিল। তবে তা এতটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়ার মতো ছিল না। আসলে দেশকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবার জন্যই সেদিন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল।

[মিল্টন বিশ্বাস লেখক : অধ্যাপক এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়]

মূল লেখাটি দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত- লিঙ্ক

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Total Post : 19