ড. মিল্টন বিশ্বাস ।।
করোনা-ভাইরাস মহামারি কবলিত ‘মুজিববর্ষে’ আমরা ছয় দফার ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্মরণ করছি। কারণ তা দুর্যোগ মুহূর্তে আত্মত্যাগের বাণী বহন করে। বঙ্গবন্ধু ছয় দফার শুরুতে বলেছিলেন (৪ঠা চৈত্র, ১৩৭২, ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬)- ‘আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবীরূপে ৬-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি।…আমার প্রস্তাবিত ৬-দফা দাবীতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি- তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ৬-দফা দাবী অনুমোদন করিয়াছেন। ফলে ৬-দফা দাবী আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে।’
‘জনগণের জাতীয় দাবীতে পরিণত’ হওয়ায় ১৯৬৬ সালেই ৬ দফা খুব দ্রুত বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্ব লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর কথা অনুসারে ৬ দফা ছিল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অন্যতম দাবিনামা। ওই দাবিগুলো ছিল ন্যায়সংগত ও জনসমর্থিত। কয়েক মাসের আন্দোলন-সংগ্রামে দাবিগুলো বাঙালির মুক্তির সনদে পরিণত হয় এবং এদেশের মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রস্তুত করে দেয়। ছয় দফা ও এর সমর্থনে আওয়ামী লীগের ডাকা ’৬৬-র ৭ জুন হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে বহু হতাহতের ঘটনার সময় বঙ্গবন্ধু ও প্রথম সারির নেতারা ছিলেন কারাগারে বন্দি। কিন্তু দল এবং দলের বাইরে জনগণ তখন সচেতন। তারা নেতাদের মুক্তি চেয়ে যেমন রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলেছিল তেমনি ৬ দফার সপক্ষে নির্বিশেষ মানুষকে স্বাধিকার অর্জনের পথে ঘর থেকে টেনে বের করে এনেছিল। অর্থাৎ রাজবন্দিদের মুক্তি ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে খুনী জালিমের বিরুদ্ধে জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে দুর্বার ও জোরদার করার কৃতিত্ব ছিল জেলের বাইরে থাকা নেতৃবৃন্দ ও জনতার।
২.
তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অবসান ঘটে। কিন্তু ওই যুদ্ধ পূর্ব বাংলার নিরাপত্তার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের চরম অবহেলা ও ঔদাসীন্যতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ফলে পূর্ববাংলার নিরাপত্তা ইস্যুতে শাসকদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি সম্পাদিত তাসখন্দ চুক্তি পর্যালোচনা করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধীদলীয় রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে একটি জাতীয় সম্মেলন ডাকেন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদল যোগ দেন। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র নিয়ে সেখানে বিভিন্ন দলের নেতারা আলোচনা করেন। আওয়ামী লীগ আগাগোড়া ফেডারেল পদ্ধতির সংসদীয় সরকার এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানিয়ে এসেছে। ১০ ফেব্রুয়ারি ছিল সাবজেক্ট কমিটির বৈঠক। সেখানে বঙ্গবন্ধু ছয় দফা উত্থাপন করেন এবং পরের দিন সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে যাতে এটি স্থান পায় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন। কিন্তু সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর এ দাবির প্রতি আয়োজকদের তরফ থেকে গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। তারা এ দাবি প্রত্যাখ্যান করে। অবশ্য দাবিনামা তখনো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কোনো সভায় গৃহীত সুপারিশ নয়। ওই দাবি উত্থাপনের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের পূর্ব বাংলার তাঁবেদাররা অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। তারা মুহূর্ত দেরি না করে শেখ মুজিবকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করতে থাকে। তাদের অভিযোগ- বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছেন। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু সম্মেলনে আর উপস্থিত না থেকে লাহোরে অবস্থানকালেই ছয় দফা প্রকাশ্যে প্রচার করে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। পরের মাসে ১ মার্চ দলের কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ফলে ছয় দফাকে নেতা-কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা অসম্ভব ছিল না। কারণ তার আগেই ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। আর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে “আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি” শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধু ‘৬ দফা’ কর্মসূচির প্রচারণায় পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলায় জনসংযোগ সফর ও সভায় বক্তৃতা শুরু করেন। এর আগে তাজউদ্দীন আহমদের নোট দেওয়া ছয় দফার একটি পুস্তিকা বের হয়। তার কিছুদিন পর দফাগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ওই পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন। ৬ দফা নিয়ে ব্যাখ্যাসংবলিত ওই পুস্তিকাটি বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে লিখেছিলেন। পুস্তিকাটি সেসময় ব্যাপক প্রচারিত হয় ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছয় দফা প্রস্তাবের কয়েকটি বিশেষ দিক ছিল এগুলো- ‘শাসনতান্ত্রিক গ্যারান্টির আওতায় পাকিস্তানের ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর প্রতিষ্ঠা, যার ভিত্তি হবে ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, সরকার হবে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির, থাকবে সর্বজনীন ভোটাধিকার ও সার্বভৌম আইন পরিষদ। ফেডারেল সরকারের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র বিষয়, অবশিষ্ট বিষয়গুলো ফেডারেশনের ইউনিটগুলোর হাতে থাকবে। দুটি পরস্পর বিনিয়োগযোগ্য মুদ্রা বা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থাসহ একটি মুদ্রাব্যবস্থা। আর থাকবে পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন প্রবাহ রোধের শাসনতান্ত্রিক বিধান।’
৩.
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে লাহোরে যেমন পাকিস্তানি শাসক ও তাদের তাঁবেদাররা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার বিরোধিতা করেছিল তেমনি দেশের অন্যান্য বিরোধী দল বিরূপ সমালোচনায় মেতে উঠেছিল। এমনকি আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাও এর সমর্থন করেননি। শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়েছিল এটি ‘সিআইএ’র তৈরি। আইয়ুব সরকার ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় মার্কিন সমর্থন পায়নি। ভিয়েতনাম ইস্যুতে চীন কর্তৃক মার্কিন নীতির সমালোচনা ও চীনকে সমর্থন জানানোর কারণে আমেরিকা ক্রুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা দিয়ে চাপে রাখছে তাদেরÑ ইত্যাদি প্রচারণা চালু করা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আওয়ামী লীগের মুখপত্র ইত্তেফাক-এর সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) তাঁর স্মৃতিকথা ‘পাকিস্তানি রাজনীতির বিশ বছর’-এ লিখেছেন- ‘৬-দফার কোন কোন দফা আমি সমর্থন করি না সত্য, কিন্তু ৬-দফা ভাল কি মন্দ, সেই প্রশ্ন মুলতবী রাখিয়াও আমি বলিতে চাই যে, এই কর্মসূচী সাধারণ্যে প্রকাশ করিবার পূর্বে আমার সাথে কেহ কোন পরামর্শ করে নাই।’ উল্লেখ্য, ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনে ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। ১৯৬৬ সালের ২৭ মার্চ মানিক মিয়া ইত্তেফাকের ‘রাজনৈতিক মঞ্চে’ লিখেছিলেন- ‘৬-দফা প্রস্তাবের এই বিপুল জনপ্রিয়তার কারণ অবশ্য কোন ব্যক্তি এমনকি কোন দলবিশেষ নয়। আজ দেশবাসীর সম্মুখে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়া উঠিয়াছে, ৬-দফার সুনির্দিষ্ট প্রোগ্রামের মধ্যেই সেই বাঁচা-মরার সমস্যার সমাধানের পথ নিহিত রহিয়াছে, ইহাই সর্বশ্রেণীর জনগণের বিশ্বাস।’
৬ দফার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ায় দলের মিছিল-মিটিং-সমাবেশে জনতার ঢল শুরু হয়। ফলে সেই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে বাদ দিয়ে ৮টি দল নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)। এই জোটে ছিল নূরুল আমীন, আতাউর রহমান খানদের জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, খাজা খয়েরউদ্দিনদের কাউন্সিল মুসলিম লীগ, গোলাম আযমের জামায়াতে ইসলামী, নসরুল্লাহ খান, সালাম খানের পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং মৌলবী ফরিদ আহমদের নেজামে ইসলাম পার্টি। ছয় দফার পাল্টা তারা একটি আট দফা দাবিনামা পেশ করে। বঙ্গবন্ধুসহ অধিকাংশ নেতা কারাগারে থাকায় সেসময় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম পিডিএমের আট দফা প্রত্যাখ্যান করে ২৯ মে এক বিবৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের ছয় দফার সমর্থনে ১৩ মে ঘোষিত ৭ জুন হরতাল পালনের আহ্বান জানান। সরকার কঠোরহস্তে হরতাল প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে সে দিনের হরতাল ও আগে-পরের দিনের জেলখানার চিত্র রয়েছে। ওই দিন হরতালের সমর্থন শুধু আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাই দেয়নি, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফাকে সমর্থন দিয়েছিল দলমত-নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ।
৪.
ছয় দফা নিয়ে প্রচার-অপপ্রচার এবং পাকিস্তানি শাসকদের দমন-পীড়ন ও ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যেও স্বায়ত্তশাসনের দাবির পক্ষে বাঙালির আত্মত্যাগ ছিল ইতিহাসের বিরল ঘটনা। ছয় দফা প্রচার কালে ১৯৬৬ সালের ৮ মে দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। কেবল বঙ্গবন্ধু নন প্রথম সারির সকল নেতাকেই কারাগারে নিক্ষেপ করে শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু বাঙালি সেদিন ঘর থেকে রাজপথের মিছিলে বেরিয়ে আসে। ৬ দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে আওয়ামী লীগের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে যায়।
ইতোমধ্যে ছয় দফার সমর্থনে ১৯৬৬ সালের ১৩ মে আওয়ামী লীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় ৭ জুন হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। হরতাল সফল করার জন্য সামরিক জান্তার হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করে দেশব্যাপী ছয় দফা দাবিতে ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, মজুরসহ আপামর জনগণ স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ, গুলিবর্ষণে শ্রমিকনেতা মনু মিয়াসহ এগারো শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয় ৭ জুন। শহীদদের রক্তে দিনটি ঐতিহাসিক গুরুত্ব অর্জন করে। বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দিবসে পরিণত হয় দিনটি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মন্তব্য- ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এগোয় সর্পিল গতিতে। আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রক্তপিচ্ছিল এই পথ। বাধা এখানে অসংখ্য। পার হতে হয় অনেক চড়াই উৎরাই। সংগ্রামের এক একটা মোড় পরিবর্তনে ইতিহাসে সংযোজিত হয় নতুন অধ্যায়। ৭ জুন আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে এমনি একটি যুগান্তকারী মোড় পরিবর্তন। ৭ জুনকে এক অর্থে বলা যায় ৬ দফার দিবস। এই দিনে ৬ দফার দাবিতে বাঙ্গালী রক্ত দিতে শুরু করে। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই ধাপে ধাপে রক্তনদী পেরিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছে। কাজেই বাঙ্গালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ৭ জুন অমর। অবিস্মরণীয় এক ঐতিহাসিক দিন ৭ জুন।’ (দৈনিক বাংলা, ৭ জুন, ১৯৭২)
১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের শিকার বাঙালি জাতি ছয় দফা দাবি প্রস্তাবের মধ্যে নতুন দিক-নির্দেশনা পেয়েছিল। স্বাধিকার আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানিদের দুঃশাসন, অত্যাচারে জর্জরিত বাঙালি দৃঢ়কণ্ঠে বারবারই অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছে। ছয় দফার সমর্থনে ৭ জুন হরতাল শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে সফল করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বীজ বপন করা হয়। লেখাবাহুল্য, ৬ দফার কারণে নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন-অবিচার নেমে আসে, আগরতলা মামলা সাজানো হয়। ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ব্যাপক ভোটে জয়ী হয়।
৭ই জুনের গুলিবর্ষণ ও আনুপূর্বিক হটকারিতায় বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে; আহত হয় অসংখ্য। আটক করে সাজা দেয়া হয় নাবালকসহ অনেক অসহায় মানুষকে। অথচ তখন দাবি ছিল সকল রাজবন্দির মুক্তি, হুলিয়া প্রত্যাহার, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা, দমনমূলক সকল বিধি-নিষেধ বাতিল করা। পূর্ব বাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা আর স্বাধিকারের জন্য অগণিত মানুষ আত্মাহুতি দিয়েছিল বলেই ছয় দফা হয়ে ওঠে বাঙালির মুক্তির সনদ।
৫.
ছয়-দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি ছিল। এজন্য বঙ্গবন্ধু ছয় দফার শেষ দফাতে দেশের নেতৃত্ব এবং জনগণের জন্য আত্মত্যাগের সদিচ্ছা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা লিখেছেন। যেমনÑ ‘পাকিস্তানের মত বিশাল ও অসাধারণ রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের অন্তরও হইতে হইবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি, আমার পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইরা এই মাপকাঠিতে আমার ছয়-দফা কর্মসূচীর বিচার করবেন। তা যদি তাঁরা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এই ছয়-দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঁচার দাবি নয়, গোটা পাকিস্তানেরই বাঁচার দাবি।’
আমাদের মুক্তির সনদ নিয়ে সমালোচনা ও বিরূপ মন্তব্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সচেতন ছিলেন প্রথম থেকেই যা ৬ষ্ঠ দফার শেষের দিকেও উল্লেখ করেছেনÑ লাহোর প্রস্তাবের জনক শেরে বাংলা ফজলুল হককে একসময় দেশদ্রোহী বলা হয়েছিল। পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকেও দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করতে হয়েছিল। এজন্য বাঙালির ন্যায্য দাবির কথা বলতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল জুলুমের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হবে তা তিনি জানতেন।
১৯৬৬ সালের আগে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাসকদের রোষানলে পরতে হয়েছে একাধিকবার। দলের সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে তা তিনি সহ্য করে টিকে ছিলেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব বাংলার মানুষের ভালোবাসাকে সম্বল করে তিনি দাবি আদায়ের কাজে যে কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত ছিলেন; অধিকার বঞ্চিত দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছুই আছে বলে মনে করেন নি। তিনি বলেছিলেন, যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলে প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছেছেন। বাকি জীবনটুকু এদেশের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি সাধনায় নিয়োজিত করতে চান। আর শেষ পর্যন্ত তা তিনি করেছিলেন বলেই ৭ ই জুন বাঙালির মুক্তির সনদের দিবস হিসেবে মহিমান্বিত হয়ে আছে আজও।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-writermiltonbiswas@gmail.com)