ড. মিল্টন বিশ্বাস
১২ এপ্রিল ( ২০২০) করোনা মোকাবেলায় সশস্ত্র বাহিনীর প্রস্তুতি সম্পর্কে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন- ‘আমরা সৈনিক, আমরা সব সময় যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং সেই প্রস্তুতি নিয়ে আমরা আছি। সবাইকে সহযোগিতা করবো।’ সেদিন করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে জেনারেল আজিজ ১৬ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন। এই নির্দেশনার আলোকে দেশজুড়ে অধিকতর তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন সদস্যরা। এখন পর্যন্ত দেশের সকল জেলা, উপজেলা এমনকি গ্রাম পর্যায়েও সাধারণ মানুষের প্রয়োজনে কাজ করে যাচ্ছেন সেনাবাহিনীর ৭ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি সদস্য। বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে লকডাউন কার্যকর এবং ত্রাণ সহায়তা প্রদানেও মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
জেনারেল আজিজ সেনা সদস্যদের উদ্দেশ্যে যে ১৬ দফা নির্দেশনা প্রদান করেন সেগুলো হলো- ‘১. আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবেলাকে একটি যুদ্ধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। একজন সৈনিক হিসেবে আমরা অকুণ্ঠচিত্তে এই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। এই যুদ্ধে আমরা জয়ী হবোই- ইনশাআল্লাহ্। ২. জনগণকে যথাযথভাবে সচেতন করাই এখন আমাদের প্রধান কাজ। আমরা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং হোম কোয়ারেন্টিনে সকলকে ঘরে থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করবো। ধৈর্য, সহনশীলতা ও সৎ সাহসের পরিচয় দিয়ে জনগণের পাশে থেকে আমরা জনগণের আস্থা অর্জন করবো। ৩. আমরা বেসামরিক প্রশাসনের সাথে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের সাথে যথাযথ সমন্বয় সাধনপূর্বক বিচক্ষণতার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবো। ৪. আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য সকল বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই গুরু দায়িত্ব পালন করবো এবং সকলের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখবো। ৫. আমরা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় এ জাতীয় কোন কাজ, কথা ও আচরণ করবো না। শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোন কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করবো না। ৬. আমরা আমাদের ‘চেইন অব কমান্ড’ মেনে চলবো এবং নেতৃত্বের প্রতি সর্বাবস্থায় আস্থাভাজন থাকবো। ৭. আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিবো। আমরা কোন গুজবে কান দিবো না এবং জনগণকে গুজব পরিহার করার জন্য উদ্বুদ্ধ করবো। কোন অপশক্তি যেন করোনা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে গুজব ছড়াতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবো। ৮. আমরা সর্বাবস্থায় শৃঙ্খলা মেনে চলবো। চলমান পরিস্থিতিতে সর্বাবস্থায় শৃঙ্খলা বহির্ভূত সকল কাজ হতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবো। ৯. আমরা আমাদের নিজস্ব নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন ও সর্বদা সজাগ থাকবো। দায়িত্বরত অবস্থায় সর্বদা মাস্ক, গ্লাভস পড়া থাকবো। অযথা কোন ব্যক্তির সংস্পর্শে যাবো না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃত্ব প্রদত্ত সকল স্বাস্থ্যবিধি ঠিক মতো মেনে চলব। ১০. আমরা নিজেরা আতঙ্কিত হবো না। দায়িত্ব পালনকালীন আমাদের কেউ করোনা আক্রান্ত হলে তার জন্য সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করবো। ১১. চলমান করোনা যুদ্ধে সিএমএইচ-সহ মেডিক্যাল কোরের সকল সদস্যগণ প্রথম সারির যোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। আপনাদের এই সেবা এবং ত্যাগ, দেশ ও সেনাবাহিনী শ্রদ্ধাভরে স্মরণে রাখবে। আমরা সবসময় আনাদের পাশে আছি। ১২. আমরা দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে মানবতা ও সহানুভূতি বজায় রাখবো। প্রয়োজনে কঠোর হবো। কিন্তু তা অশালীন, দৃষ্টিকটু বা মানবতা বিরোধী হলে চলবে না। ১৩. আমরা আমাদের দায়িত্ব কোন অবহেলা বা শিথিলতা প্রদর্শন করবো না। আমাদের নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার মনোভাব দেখিয়া জনগণকে সচেতন করে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ সচেষ্ট থাকবো। ১৪. আমরা নিজ নিজ ধর্ম পালন করবো। তবে ধর্মীয় উপাসনালয়ে না যেয়ে। রুমের মধ্যে একাকী পালন করবো। ১৫. আমরা নিজেদের মধ্যেও সর্বদা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবো যাতে করে আমরা সুস্থ থেকে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারি। ১৬. সর্বোপরি আমরা আমাদের পরিবার পরিজনদের যথাযথ খোঁজ খবর রাখবো। তাদেরকে সাবধান থাকতে বলার পাশাপাশি যে কোন সমস্যা যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করার মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করবো।’
এই ১৬ দফা নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করার বিষয়টি ত্বরান্বিত করার জন্য জেনারেল আজিজ পুনরায় আরো কিছু পরামর্শ দেন তাঁর অফিসারদের।৬ মে তিনি সেনাবাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিংদের (জিওসি) সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময় করে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সেসব নির্দেশনা প্রদান করেন। সেনাপ্রধান ওই সময় বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তার নির্দেশনা বাস্তবায়নে সেনাবাহিনী সর্বদা প্রস্তুত রয়েছে।’ সেদিন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছিল, সেনাবাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় তাদের প্রতিটি সদস্যের জন্য বরাদ্দ করা রেশন থেকে অসহায়, দুস্থ ও গরিবদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন সেনাপ্রধান। এছাড়া তিনি অসুস্থ, গরিব রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া অব্যাহত রাখার নির্দেশনাও দেন। সংবাদপত্র সূত্রে জানা যায়, ৩০ এপ্রিল সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮ হাজার পরিবারের জন্য ত্রাণসামগ্রী প্রদান করেছে সেনা কল্যাণ সংস্থা। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সেনা কল্যাণ সংস্থার ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সেনাবাহিনীপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের নির্দেশক্রমে এবং সেনা কল্যাণ সংস্থার চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল সাজ্জাদুল হকের নেতৃত্বে সংস্থাটি শুরু থেকেই সরকার ও জনগণের পাশে দাঁড়ায় এবং অতি দ্রুততার সঙ্গে সংস্থার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর এক দিনের বেতনসহ ৫ কোটি ১০ লক্ষাধিক টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে জমা করে। এ ছাড়া আশকোনা হজ ক্যাম্পের কোয়ারেন্টিন সেন্টারে বিভিন্ন ব্যবহার্য সরঞ্জামসহ ১৫০ সজ্জা প্রদান ও স্থাপন করে দেয়। করোনাভাইরাসের প্রকোপে সেনা কল্যাণ সংস্থার বিভিন্ন কলকারখানা বন্ধ হয়ে পড়লে কর্মহীন শ্রমিকদের মধ্যেও নিয়মিত ত্রাণ বিতরণ করছে সংস্থাটি। পাশাপাশি সেনা কল্যাণ সংস্থার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলালিংক, ওয়ালটন গ্রুপ, ফিনিক্স গ্রুপ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ, মোংলা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতো দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
মূলত সেনাপ্রধানের নির্দেশনা, পরামর্শ ও নজরদারির মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর এবং প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নিজের কাঁধে বহন করে গরিব জনগোষ্ঠীর কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন সেনা সদস্যরা। মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মার্চ থেকে শুরু হয়ে মে মাস অবধি চলা দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাবান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ এক ভিন্ন মানবিক পরিচয় দেখতে পাচ্ছি আমরা। উল্লেখ্য, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ পহেলা এপ্রিল (২০২০) সচিবালয়ের একটি সভা শেষে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ‘করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুদ্ধিমান নেতৃত্বে সেনাবাহিনী যথাসম্ভব কাজ করছে।’ তাঁর বাহিনী এই রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। তিনি আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনী যতক্ষণ সরকার চাইবে ততক্ষণ নাগরিক সেবায় সহায়তা প্রদান করবে।’ করোনার ধাক্কায় গোটা বিশ্ব যখন দিশেহারা তখন বাংলাদেশ পরিস্থিতি সামলে চলেছে দৃঢ়চিত্তে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩১ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা ২৪ মার্চ থেকে দিনরাত কাজ করছেন। দেশের মানুষকে বাসায় ঢুকিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ সচেতনতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তারা।
২.
বাংলাদেশে ৮ মার্চ করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংবাদ পাবার পর শেখ হাসিনা দ্রুত নানামুখি ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি দেয়া, দেশের বিভিন্ন স্থান লকডাউন করা, একাধিক দফায় সরকারি ছুটি বাড়িয়ে ৩০ মে করা, করোনাভাইরাস আক্রান্তদের জন্য টেস্টের আওতা বৃদ্ধি, সামাজিক দূরত্ব সৃষ্টি, লোকজনকে নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করানো, কোয়ারেন্টাইনে রাখতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ত্রাণ বিতরণÑ এসব পদক্ষেপ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে জরুরি ছিল। কিন্তু এসব ব্যবস্থার সঙ্গে ২৪ মার্চ থেকে মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার জন্য সেনাবাহিনী নামানো ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে নৌবাহিনীর সদস্যকেও মোতায়েন করা হয়েছে। অন্যদিকে বিমান বাহিনী মেডিকেল এইডের কাজ করছে। সেসময় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) থেকে জানান হয়, ‘জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে সেনাবাহিনী করোনাভাইরাস সংক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাব্যবস্থা, সন্দেহজনক ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা পর্যালোচনা করবে। বিশেষ করে বিদেশফেরত ব্যক্তিদের কেউ নির্ধারিত কোয়ারেন্টিনের বাধ্যতামূলক সময় পালনে ত্রুটি/অবহেলা করছে কি-না, তা পর্যালোচনা করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরা স্থানীয় আর্মি কমান্ডারের কাছে অবস্থা পর্যালোচনার জন্য আইন অনুসারে সেনাবাহিনীর কাছে অনুরোধ জানাবেন। নৌবাহিনী উপকূলীয় এলাকায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় কাজ করবে। বিমানবাহিনী হাসপাতালের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সামগ্রী ও জরুরি পরিবহন কাজে নিয়োজিত থাকবে।’ এর আগে আমরা মনে করতাম সশস্ত্র বাহিনী জনমনে ভীতি সৃষ্টি করে, মনে করতামÑ তাদের কাজ যুদ্ধের মাঠে, শান্তি স্থাপনের জন্য কঠোর হস্তে বিশৃঙ্খলা দূর করা এবং বন্দুক উঁচিয়ে সবসময় জনগণকে শাসন করা। কিন্তু বিস্ময়করভাবে আমরা দেখতে পেলাম, সেনাবাহিনী ২৪ মার্চ থেকে গ্রামে-গঞ্জে, মাঠে-বাজারে মাইকিং করছেন জনগণকে করোনা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করার জন্য, সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরিয়ে সাহায্য করছেন। অস্ত্র উঁচিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নয় বরং নিজের জীবন বাজি রেখে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে মানুষের জীবন বাঁচাতে দায়িত্ব পালন করছেন।
অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সেনা সদস্যরা মাঠে নামার আগে ১৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেনা পরিচালনায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের কথা জানিয়েছিলেন। ঢাকা বিমানবন্দর সংলগ্ন আশকোনা হজ ক্যাম্প ও উত্তরার পাশে দিয়াবাড়িতে কোয়ারেন্টিনের দায়িত্বে নিয়োজিত করা হয় সেনাবাহিনীকে। অবশ্য হাজি ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে এর আগেই ছিলেন সেনাবাহিনী। কিন্তু বিদেশ ফেরতদের হোম কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করার পরও বিভিন্ন জেলায় তাদের বাইরে বের হওয়া তথা জনসম্পৃক্ততা ঠেকানো যাচ্ছিল না। এজন্য অনিবার্য হয়ে পড়ে মাঠ পর্যায়ের কাজে সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে সহায়তা প্রদান করা। অর্থাৎ বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিনের শতভাগ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী দায়িত্ব পালন করেছেন।
৩.
লেখাবাহুল্য, সেনা সদস্যরা সারা দেশেই করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জনসচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছেন। প্রত্যন্ত এলাকায় উপস্থিতি হয়ে যাদের হোম কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশনে থাকার কথা তাদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন। সামাজিক দূরত্ব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে মাঠে-ঘাটে সার্বক্ষণিক তদারকিতে আছেন। সাধারণ জনগোষ্ঠীকে মাইকিং করে নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ বিবিধ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অনুরোধ জানাচ্ছেন। কোনো এলাকায় রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা প্রদানে যেমন সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে দিয়েছেন তেমনি পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করার জন্য তাদের তরফ থেকে জীবাণুনাশক ছিটানো হচ্ছে। আসলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী সেনাবাহিনী কেবল আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দেননি তারা স্থানীয় প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছেন। যেমন দুস্থদের ত্রাণ কাজে অব্যবস্থাপনা দূর করার জন্য সহযোগিতা করছেন তেমনি কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে কিংবা শাস্তি যোগ্য অপরাধ করলে তা ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তাৎক্ষণিক বিচার করে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। চরাঞ্চল কিংবা পাহাড়ি উপত্যকায় বাজার চালু রাখা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, গরিবদের মধ্যে খাবার বিতরণে সহায়তা করা, বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখার কাজও তাদের করতে হচ্ছে। পহেলা এপ্রিল আইএসপিআর থেকে পুনরায় বলা হয়, সরকার প্রদত্ত নির্দেশাবলি অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফলে ২ এপ্রিল থেকে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন সেনাবাহিনী। আমাদের দেশে প্রায় ৩০ হাজার আক্রান্ত হওয়ায় করোনা পরিস্থিতির ব্যাপক বিস্তার রোধে কাজ করছেন সেনাবাহিনী। আসলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাসমূহের সঙ্গে জনসাধারণের আন্তরিক অংশগ্রহণকে সম্ভব করে তুলছেন সেনা সদস্যরা।
একথা সত্য সাধারণ মানুষের মাঝে সেনা সদস্যদের উপস্থিতি ও সহায়তার কারণে গণ-মনস্তত্ত্বে স্বস্তি এসেছে। কারণ করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ জুড়ে কাজ করায় আইন-শৃঙ্খলারও উন্নয়ন ঘটেছে। অন্যদিকে যাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছে তারা প্রয়োজনে ও জরুরি পরিস্থিতিতে চিকিৎসা সেবা দিতে প্রস্তুত বলেই অনেক জায়গায় তাদের চিকিৎসা ক্যাম্প পরিচালনা করতে দেখা যাচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেমন চিকিৎসক, নার্সসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মী করোনা মোকাবেলায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তেমনি সেনা সদস্যরা নিজের পরিবারকে পেছনে ফেলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।
আগেই বলেছি, বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের নির্দেশনায় তারা কাজ করছেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা কাঁধে করে খাদ্য সহায়তা নিয়ে মানুষের বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসছেন। আর সেটাও নিজেদের রেশনের থেকে অর্থ বাঁচিয়ে যা ৩০ এপ্রিলের সংবাদ থেকে আমরা জেনেছি। আর তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩ মে থেকে রাজধানীর ভাষানটেক থানাধীন ৪ নং অফিসটেক বস্তিতে কোনো রকম জনসমাগম না করে ত্রাণ বিতরণ করেছেন সদর দফতর ৮৬ স্বতন্ত্র সিগন্যাল ব্রিগেড। ত্রাণ বিতরণকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ হতে এই সিগন্যাল ব্রিগেড মাইকিং করে বলেন, ‘ঘর থেকে কেউ বের হবেন না, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখুন। আমরা আপনাদের সবার ঘরে ত্রাণ পৌঁছে দেবো, ঘর থেকে বের হলে তাদের ত্রাণ দেবো না।’
৪.
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক অভিনব প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হলো, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জীবাণুনাশক টানেল এবং কন্টাক্ট ট্র্যাকিং পোস্ট স্থাপন। ৭ মে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র এবং খুলনার ডিসি’র উপস্থিতিতে সেনাবাহিনীর উদ্যোগে নির্মিত ডিসইনফেক্টিং টানেল শহরের শের এ বাংলা রোডে উদ্বোধন করা হয়। মহামারি মোকাবেলায় গত দু’মাস যাবৎ সরকারের সঙ্গে ফ্রন্টলাইনে আছেন সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ। মানবতার টানে অতীতের সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতোই নির্ভীকচিত্তে খুলনা বিভাগের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশন। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে মাগুরা, যশোর, খুলনা এবং ঝিনাইদহে এই ডিভিশনের তত্ত্বাবধানে জীবাণুনাশক টানেল স্থাপন করা হয়েছে। শহরে প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় সকল ব্যক্তি, মোটরসাইকেল, সাইকেল, ভ্যান-রিকশা এই ট্যানেলের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। স্থাপনকৃত টানেলের ভেতরে দিনের একটি বড় সময় ধরে জীবাণুনাশক ডিটার্জেন্ট স্প্রে করা হচ্ছে। জীবাণুমুক্ত করতে পানির সঙ্গে মানুষের ব্যবহার উপযোগী ডিটারজেন্ট ও খার জাতীয় মেডিসিন ব্যবহার করা হয় এ ট্যানেলে। এর ফলে সকল ধরনের যানবাহন এবং মানুষের শরীরে লেগে থাকা জীবাণু নষ্ট করা সম্ভব হচ্ছে।
এছাড়াও সেনানিবাসের মেডিকেল টিম দেশের বিভিন্ন জায়গায় কাজ করছেন যা আগেই আমি একবার উল্লেখ করেছি। যশোর সেনানিবাসের মেডিকেল টিম চলতি মাসে মাগুরায় প্রবেশদ্বারে স্থাপনকৃত কন্টাক্ট ট্র্যাকিং পোস্ট অতিক্রম করার সময় প্রতিটি মানুষকে স্বাস্থ্য ক্যাম্পে নিয়ে শরীরের তাপমাত্রাসহ করোনার নানা উপসর্গ পরীক্ষা করছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় করোনার ঝুঁকি কিংবা ভাইরাস শনাক্ত হলে ওই ব্যক্তির তথ্য তার নিজের জেলার ডিসিকে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এজন্যে তার ছবি তুলে রাখাসহ জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য সংরক্ষণ করছেন মেডিকেল টিম। এছাড়া বিভিন্ন সেনানিবাসের মেডিকেল টিম অসহায় মানুষদের চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব, হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিতকরণ ছাড়াও গণপরিবহন চলাচল, ত্রাণ বিতরণ, অসহায় কৃষকদের ক্ষেত থেকে সবজি ক্রয় এবং দুস্থ কৃষকদের মাঝে বিভিন্ন প্রকার শস্য/সবজি বীজ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন।
৫.
করোনা মোকাবেলায় সম্পূর্ণ পেশাদারী মনোবৃত্তির অধিকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভিন্ন এক মানবিক পরিচয় দেখছে আজ দেশবাসী। করোনার বিরুদ্ধে চলতি লড়াইয়ে সামনে আছেন তারা। ‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে’Ñ এই স্লোগানে উদ্দীপ্ত এই সেনা সদস্যরা। মারমুখী মনোভাব ত্যাগ করে মানবিকতার বর্ম পরে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছেন তারা। জেনারেল আজিজ বলেছেন, ‘যতো প্রয়োজন সেনা সদস্য ততো দেওয়া হবে। অতিরিক্ত সেনা সদস্যের কার্যক্রমে মানুষের মধ্যে কোনো আতঙ্ক সৃষ্টির কারণ নেই।’ ধন্যবাদ জেনারেল, পাশে থাকুন এভাবেই। আসলে আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত এবং যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় পারঙ্গম আমাদের সেনাবাহিনী সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন বলেই মহামারিতে দিশেহারা ইউরোপ-আমেরিকার তুলনায় এখনও অনেক ভাল অবস্থায় আছি আমরা। তবে মাঠ পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত সেনা সদস্যদের অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
২৩ মে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত এক হাজার ২০ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া ৯২ জন পরিবারের সদস্য এবং সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেসামরিক ও অন্যান্য ২৫২ জন আক্রান্ত, মারা গেছেন ১০ জন। আক্রান্তদের মধ্যে ৯৩৩ জন বিভিন্ন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। ৪২১ জন সুস্থ হয়ে নিজ নিজ আবাসস্থলে ফিরেছেন। এছাড়া ভর্তি অন্য রোগীরা সুস্থ আছেন। জানা গেছে সংক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই করোনা আক্রান্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসার জন্য সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ বিষয়ে ঢাকা সিএমএইচসহ সব সেনানিবাসের সিএমএইচে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
আশা করা যায়, করোনা মহামারিতে মানুষের কল্যাণে দায়িত্ব পালনকালে সেনা সদস্যদের কেউ আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ থাকবে না। তাদের মানবিক কার্যক্রমের সাফল্য কামনা করছি।
(লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম এবং অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, email-writermiltonbiswas@gmail.com)