মিল্টন বিশ্বাস
সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠীর ইতিহাস গবেষণার
কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে। ২০১২ সালে এ গোষ্ঠীর প্রকাশনা
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। ‘সাব-অল্টার্ন
স্টাডিজ’ আর বের হবে না। তিন দশক ধরে কাজ করার পর এ গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ড
বন্ধ করে দেওয়া উচিত মনে করেছেন প্রধান তাত্ত্বিকরা। প্রত্যেকে এখন তাঁদের নিজের
মতো করে কাজ করছেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চায় সাহিত্য, দর্শন,
ন্যায়শাস্ত্র, ধর্ম, বর্ণ
ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। অর্থাত্ নিম্নবর্গের ইতিহাস
কোনো একক অথবা পৃথক জ্ঞানকাণ্ড নয়। বিশ্বব্যাপী এ জ্ঞানকাণ্ডের প্রভাব এখনো বহাল।
ল্যাটিন আমেরিকাতে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। সেখানে
সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ আলাদা গোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত। জাপানেও বেশ কিছু আলোচনা
হয়েছে। ইংরেজি ভাষায় বেশিরভাগ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ায় ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াতে
এ গোষ্ঠীর লেখকদের নাম প্রায়ই উচ্চারিত হয়ে থাকে। মূলত দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসতত্ত্ব
বিশ্বজয় করেছে ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ প্রকাশনার মধ্য দিয়ে। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার এই
গবেষণা-প্রকাশনার ইতিহাস বলার আগে এ গোষ্ঠী কর্তৃক ব্যবহূত ‘সাব-অল্টার্ন’ বা নিম্নবর্গ শব্দের ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে।
১.
‘সাব-অল্টার্ন’ শব্দের বাংলা পরিভাষা ‘নিম্নবর্গ’। এটি একটি সাপেক্ষ শব্দ। একে আলাদা করে খোঁজার চেয়ে উচ্চবর্গের সঙ্গে তার
সম্পর্কের সূত্রে খোঁজা দরকার। এই সম্পর্ক ক্ষমতার সম্পর্ক। আর এই ক্ষমতার
সম্পর্কের জন্য ‘পদমর্যাদার ক্রমোচ্চবিন্যাসে পার্থক্যের স্তর পরম্পরায় সমাজের একেবারে পাদদেশে
অবস্থান করেও প্রত্যেক নিম্নবর্গ তার চেয়ে নিচুস্তরের যে কারো তুলনায় উচ্চবর্গ।’ এ গোষ্ঠীর অন্যতম লেখক ডেভিড আর্নল্ড এর দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ‘এলিট শ্রেণীর জমিদারের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে ধনী কৃষক নিম্নবর্গ আবার
আধিপত্যের দিক থেকে এই ধনী কৃষক গ্রামীণ দরিদ্র ভূমিহীন মজুর, কারিগর ও অন্ত্যজ শ্রেণীর তুলনায় উচ্চবর্গ।’ এ কারণে এটি একটি অবিরাম প্রক্রিয়ার প্রত্যয়। যেকোনো সমাজে
আধিপত্য ও অধীনতার স্বরূপ বিশ্লে¬¬ষণের মধ্য দিয়ে
নিম্নবর্গকে চিহ্নিত করা সম্ভব।
Subaltern Studies গোষ্ঠীর প্রধান উদ্যোক্তা রণজিত্ গুহ সর্বপ্রথম ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটি ইংরেজি Subaltern শব্দের
প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলা ভাষায় গ্রহণ করেন। নব্বইয়ের দশকব্যাপী তাঁর সম্পাদিত ছয়
খণ্ড Subaltern Studies (1982-1989) সিরিজ প্রাতিষ্ঠানিক
জ্ঞানজগতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। Subaltern Studies প্রথম
খণ্ডের Preface-এ তিনি বলেছেন, দক্ষিণ
এশিয়ার নিম্নবর্গ বিষয়ে একটি সুশৃঙ্খল ও তথ্যবহুল আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণই এই
প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। তিনি নিম্নবর্গের অর্থ নির্ণয়ে Concise Oxford
Dictionary-এর আশ্রয় নিয়েছেন : The word ‘Subaltern’ in the title stands for the meaning as given in the Concise Oxford
Dictionary, that is, ‘of inferior rank’. It will be used in these pages as a name for the general attribute of
subordination in South Asian Society whether this is expressed in terms of
class, caste, age, gender and office or in any other way. তবে
সাব-অল্টার্ন বা নিম্নবর্গ ধারণাটি সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ গোষ্ঠীর লেখকরা আন্তোনিও
গ্রামশির Selections from the Prison Notebooks গ্রন্থ থেকে
পেয়েছেন। এ গ্রন্থে ইতালীয় ‘সুবলতের্নো’ শব্দটির ইংরেজি করা হয় ‘সাব-অল্টার্ন’। ইংরেজি ভাষায় এ শব্দটির আভিধানিক অর্থ ক্যাপ্টেনের অধস্তন কর্মকর্তা।
সাব-অল্টার্নের সমার্থক শব্দ ‘সাবর্ডিনেট’। মুসোলিনির কারাগারে বন্দি নব্য মার্কসবাদী (প্রাক্সিসের দর্শন) গ্রামশির
রচনায় শব্দটির নতুন তাত্পর্য অভিব্যক্ত হয়েছে। গ্রামশির রচনার ইঙ্গিতসমূহ অনুসরণ
করেই ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’-এর তাত্ত্বিকরা ‘নিম্নবর্গ’ ধারণাটি গ্রহণ করেছেন। আন্তোনিও গ্রামশির প্রিজন নোটবুকসের Notes
on Italian History অধ্যায়ের History of the subaltern
classes : Methodological criteria অংশে বর্ণিত ছয়টি দিকনির্দেশে
নিম্নবর্গ শ্রেণীর জীবনযাত্রা, আচার-আচরণ, ভাবাদর্শ গভীরভাবে পাঠ করার যে প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে, তার সঙ্গে সংলগ্নতার কথা বলেছেন রণজিত্ গুহ। অর্থাত্ গ্রামশি এই তত্ত্বের
ভ্রূণ।
শ্রেণী, জাতি-বর্ণ, সম্প্রদায়,
বয়স, লিঙ্গ অথবা কর্মস্থল যেখানে বর্তমান
থাকুক না কেন, দক্ষিণ এশীয় সমাজব্যবস্থায় অধীনতার সাধারণ
রূপগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ ঘরানার লেখকরা। অধীনতার
জটিল শাখা-প্রশাখাগুলো সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন থাকার কারণে সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ
গোষ্ঠী সাব-অল্টার্নিটির দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাস, রাজনীতি,
অর্থনীতি এবং সমাজনীতি আর অগ্রন্থিত আচরণ, আদর্শ
ও বিশ্বাসের পরিচয় যে সংস্কৃতি ধারণ করে তার সামগ্রিক রূপটি তুলে ধরেছেন গবেষণায়।
নিম্নবর্গতার ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি,
সমাজনীতি এবং একই সঙ্গে তার আচার-আচরণ, ভাবনাচিন্তা
ও দৃষ্টিভঙ্গি সবকিছুই এককথায় সংস্কৃতি হিসেবে চিহ্নিত। এঁদের রচনায় কেবল
ঔপনিবেশিক ভারত নয়, ঔপনিবেশিক-উত্তর অনুষঙ্গও আলোচিত হয়েছে।
এ গোষ্ঠী ঔপনিবেশিক ভারতের বৃহত্তর গ্রামীণ রূপান্তরের ওপর বিশেষ দৃষ্টি নিক্ষেপ
করেছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন সামাজিক অধীনতাকে। প্রাথমিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বিকল্প
ইতিহাস অন্বেষণে গ্রামীণ নিচুশ্রেণীর স্বর এবং ঔপনিবেশিক কালে সংঘটিত তৃণমূল
কৃষকশ্রেণীর প্রতিরোধ-উদ্যোগ সম্পর্কে নতুন ব্যাখ্যা প্রদান করতে চেয়েছেন এ
গোষ্ঠী। ঔপনিবেশিক কালে দক্ষিণ এশিয়ার কৃষকদের রাজনৈতিক চেতনাহীনতা বা নিষ্ক্রিয়তা
সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা বাতিল করে যথার্থ উত্তর-আধুনিক বা উত্তর-উপনিবেশ
অনুচিন্তনে কৃষকের চেতনা, সক্রিয়তা ও ক্ষমতা সম্পর্কে আলোচনা
প্রাধান্য পেয়েছে। এ কারণে এ জ্ঞানকাণ্ডের নিম্নবর্গতার পদ্ধতিতে নিম্নবর্গের
সংগুপ্ত বিশুদ্ধ নির্মিতি উদ্ঘাটন করার জন্য কৃষকের প্রতিবাদ প্রকাশকৌশল, এখন পর্যন্ত তার অধীনতার স্বরূপ ও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব আলোচিত হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস প্রক্রিয়ার ভেতর কৃষকশ্রেণীকে পুনর্বহাল করেছেন এ গোষ্ঠীর
লেখকরা। মূলত সাব-অল্টার্ন গোষ্ঠী ইতিহাসতত্ত্বের দিক থেকে ঔপনিবেশিক ভারতের কৃষক
এবং কৃষক বিদ্রোহকে নিম্নদেশ থেকে (from below) যেমন দেখেছেন
তেমনি ভেতর থেকে নতুন দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করেছেন।
রণজিত্ গুহ অধীনতাকে বোঝার জন্য গ্রামশির মতোই বিপরীত যুগ্মপদ
(আধিপত্য-অধীনতা) গ্রহণ করেছেন। কারণ নিম্নবর্গ সব সময় শাসকগোষ্ঠীর অধীন থাকে
এমনকি বিদ্রোহ ও জেগে ওঠার মুহূর্তেও তারা শাসকবর্গের কর্মকাণ্ডের অধীন। তাঁর
ব্যবহূত dominance ও subordination শব্দ
দুটির অর্থ যথাক্রমে আধিপত্য ও অধীনতা। আধিপত্য মূলত এলিট বা উচ্চবর্গের প্রভুত্ব,
প্রতাপ বা শাসনকে বোঝায় আর অধীনতা নিম্নবর্গের শাসিত হবার রূপটি
উন্মোচিত করে। গ্রামশি প্রিজন নোটবুকসে একাধিক বার dominant classes,
dominant groups, hegemony শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন। এরই বিপরীতে
রয়েছে সাব-অল্টার্ন গোষ্ঠী। প্রভুত্ব, কর্তৃত্ব, শাসন বা প্রতাপের বিপরীতে অধীন, দলিত, শোষিত, নিপীড়িত এই দ্বিমাত্রিক অনুষঙ্গ বিজড়িত। ‘নিম্নবর্গ’ শব্দটা কার্যত বাইনারি বৈপরীত্যের আদলে গড়া। কেননা, আমাদের মননবিশ্বে বা ব্যক্তিক চেতনার সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হয়ে বসে ‘উচ্চবর্গ’ চেতনাটা। সুতরাং ওই অবস্থানটা অবশ্যগ্রাহ্য মেনে নিয়েই ‘নিম্নবর্গ’ ক্লাস। সে সরকারি, বেসরকারি, বা সরকার মদতপুষ্টর দল হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। অর্থাত্ ঠিক বিপরীত
অবস্থান। সুতরাং বাইনারি বৈপরীত্য বজায় থাকছেই। জীবনযাপনের অবস্থানগত লক্ষণ এবং
হেজিমনির সাহায্যে অর্থাত্ প্রতাপ ও আধিপত্যের ফলে নিম্নবর্গ ডমিন্যান্ট-এর
বিপরীত। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং শ্রেণীবিভক্ত সমাজের সকল অভিব্যক্তি
উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ এই বিপরীত যুগ্মপদ দিয়ে বোঝা সম্ভব। ‘ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও সমাজে এমন কোনো অভিব্যক্তি নেই যা এই দ্ব্যণুক সম্বন্ধ
দিয়ে বোঝা বা বোঝানো যায় না। জাত শ্রেণী সমপ্রদায় ও অন্যান্য সমূহের নানা অংশের
মধ্যে, রাজাপ্রজা স্ত্রীপুরুষ
জ্যেষ্ঠকনিষ্ঠ প্রভৃতির মধ্যে, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনের সর্বত্র ক্ষমতাবৈষম্য সেই বৈপরীত্যের বিশেষ
বিশেষ প্রকাশ। এবং তা যেমন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রকট, আঞ্চলিক
ক্ষেত্রেও তেমনি।’
অর্থাত্ ‘সাব-অল্টার্ন’ বলতে আমরা বুঝি শ্রেণী, জাতিবর্ণ,
পদমর্যাদা, ক্ষমতা, কর্তৃত্ব
এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ও পেশাগত অবস্থানের দিক থেকে প্রাধান্যভোগী জনগোষ্ঠীকে।
নিম্নবর্গ শিক্ষায়, অর্থনৈতিকভাবে এবং সামাজিক মর্যাদায়
অনগ্রসর, অনুন্নত। সর্বোপরি শারীরিক শ্রমে নিযুক্ত দরিদ্র
জনগোষ্ঠীও নিম্নবর্গ। উচ্চবর্গের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক সূত্রে নিম্নবর্গ হচ্ছে
প্রান্তিক, প্রাকৃতজন, উপেক্ষিত।
সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাত্পদ জনগোষ্ঠী। ভারতবর্ষ কিংবা বাংলাভাষী ভূখণ্ডে তপশিলি
জাতি (SC/Scheduled Castes), তপশিলি আদিবাসী (ST/Scheduled
Tribes) এবং অন্যান্য হিন্দু ও অ-হিন্দু (OBC/Other Backward
Class) শ্রেণী সামাজিক বা বর্ণগত, অর্থনৈতিক ও
শিক্ষাগতভাবে অনুন্নত কিংবা অনগ্রসর এবং সর্বোপরি উচ্চবর্গের অধীন হলে তাদের আমরা
নিম্নবর্গ হিসেবে চিহ্নিত করব। ভারতবর্ষের সমাজে প্রাচীন কাল থেকেই অর্থনৈতিক
শ্রেণী ছিল। সামাজিক সম্পদের উত্পাদন ও বণ্টন অনুযায়ী এই শ্রেণী হলো কৃষি, শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য সংশ্লি¬¬ষ্ট। শ্রেণীর
ধারণাটি অর্থনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। যথা, সামন্ত
সমাজে ভূস্বামী ও ভূমিদাস, বুর্জোয়া সমাজে বুর্জোয়া ও
প্রলেতারিয়েত। অন্যদিকে ‘সাব-অল্টার্নে অর্থনীতির সঙ্গে
ইতিহাস এবং সংস্কৃতির যোগাযোগের বিবেচনাটাও এসে যায়।’ অর্থাত্ অর্থনীতির ভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট শ্রেণী বিভাজন নয়;
নিম্নবর্গ-উচ্চবর্গ প্রত্যয় ক্ষমতার সম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। যেমন
ক্ষেতমজুর হিসেবে স্বামী-স্ত্রী একই শ্রেণী কিন্তু পরিবারে আধিপত্যের দিক থেকে
স্বামী উচ্চবর্গের, স্ত্রী নিম্নবর্গের। এভাবে শিক্ষক-ছাত্র
একই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত কিন্তু আধিপত্যের দিক থেকে শিক্ষক উচ্চবর্গ,
ছাত্র নিম্নবর্গ। মূলত ব্যাপক অর্থে ক্ষমতার সম্পর্ক দিয়ে
উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ বিচার করতে হবে। আসলে ‘নিম্নবর্গ’ একটি সম্পর্কের নাম। ক্ষমতাবিন্যাসের নানা ধরন উচ্চ এবং নুি
উভয় বর্গকে নির্ধারণ করে। অবস্থান ভেদে বর্গের ধরনও পাল্টায়।
‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা বা কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কথাই বলে না,
রাষ্ট্রবহির্ভূত ক্ষমতার প্রসঙ্গ তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষমতার
সার্বভৌমিক বা ব্যক্তিগত রূপের বাইরে যে ‘অদৃশ্য
বিকীর্ণ’ অবয়ব সে সম্পর্কে বিশিষ্ট গবেষক ও নিম্নবর্গের ওপর বহু
গ্রন্থের রচয়িতা গৌতম ভদ্রের মত, ‘কেন্দ্রীভূত
ক্ষমতাই একমাত্র ক্ষমতা নয়। কিন্তু ‘বিকীর্ণ
ক্ষমতা’ প্রতিনিয়ত আমাদের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে জন্ম হচ্ছে। আমরা শুধু
কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার কথা বললে, আমরা শুধু তার স্ট্র্যাটেজির
কথা ভাবি। তার সঙ্গে কিভাবে লড়াই করতে হবে। কিন্তু আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কে যে
বিকীর্ণ ক্ষমতা তৈরি হয়, ছাত্র-শিক্ষক, বাড়িতে-রাস্তায়, সাধারণ-স্বাভাবিক আদান-প্রদানে,
সেই ক্ষমতার আমরা কোনো তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারিনি। যার ফলে
ক্ষমতার সম্পর্ক চলতেই থাকে…।’ গৌতম ভদ্রের এই কথার সঙ্গে মিশেল ফুকোর প্রতাপতত্ত্বের সাধর্ম্য আবিষ্কার
করা যায়। সমাজের সর্বত্র ক্ষমতা ছড়িয়ে আছে। অর্থাত্ ‘ক্ষমতা সব জায়গা থেকে আসে, এবং সামাজিক
বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতা স্থির নয়, সদাচঞ্চল,
মুহূর্তে সে তৈরি হচ্ছে।’ যেখানে ক্ষমতা আছে সেখানেই প্রতিরোধ প্রয়োজন। সমাজে অবিরাম বলপ্রয়োগ চলছে।
এ কারণেই ক্ষমতার বিস্তার সর্বত্র। ক্ষমতার সর্বত্র বিস্তারের জন্য প্রতিরোধও
সবখানে হবে। তবে সেই প্রতিরোধ সংঘবদ্ধভাবে বলপ্রয়োগকে উত্পাটিত করবে না, বরং তা হবে ব্যক্তিক পর্যায়ে। সার্বিক প্রতিবাদের বদলে আপেক্ষিক
প্রতিবাদের কথা বলেছেন ফুকো। পারিবারিক সম্পর্কে, সামাজিক
প্রতিষ্ঠানে, প্রশাসনে, শাসক ও শাসিত
শ্রেণীর সম্বন্ধবিন্যাসে ক্ষমতার সক্রিয়তা লক্ষ করা যায় ফুকোর তত্ত্বে। অর্থাত্
ক্ষমতার দ্বারা গ্রস্ত হওয়া আবার অন্যের ওপর ক্ষমতা প্রসারিত করাও ব্যক্তির কাজ।
মূলত ক্ষমতা ও প্রতিরোধের মিথস্ক্রিয়ার কথাই মিশেল ফুকো বলেছেন। সর্বত্র ছড়ানো
প্রভুত্ব ও শোষণের ধারণা থেকেই নিম্নবর্গের তাত্ত্বিকরা উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গ
সম্পর্ককে যাচাই করে দেখতে চান। প্রত্যেক মানুষ ক্ষমতা ব্যবহার করে, আবার একই সঙ্গে সে ক্ষমতার দ্বারা অধীন হয়। রাষ্ট্র নয়, সমাজের ভেতর ক্ষমতার এই পারস্পরিক আদান-প্রদান ও গতিবিধি নিম্নবর্গ
প্রত্যয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ। ‘নিম্নবর্গের
ইতিহাসবিদেরা যা করেছেন তা হলো গ্রামশির কাছ থেকে নিয়েছেন নিম্নবর্গ ও আধিপত্যের
ধারণা; আর ফুকোর কাছ থেকে নিয়েছেন
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকৃত অবস্থান ও আপেক্ষিকতার প্রত্যয়।’
২.
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্র এবং অন্যরা বিস্তৃত পরিসরে নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চার
পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করেছেন। সত্তরের দশকজুড়ে ভারতবর্ষে মার্কসবাদী রাজনৈতিক
বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস সংক্রান্ত বিভিন্ন বিতর্কের
পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজে’র শিকড় খুঁজে পাওয়া যায়। এ সময় একদিকে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে একদলের বক্তব্য
ছিল— ১. ঔপনিবেশিক আমলের শেষ পর্বে পুঁজিবাদী উত্পাদন রীতির উদ্ভব
অর্থাত্ কৃষি উত্পাদনে আমূল পরিবর্তন সূচনা হয়। অপরপক্ষের— ২. ব্রিটিশ শাসন আমলে কিছু এলাকায় সীমিতভাবে পরিবর্তন সত্ত্বেও
ভারতের বিস্তৃত অঞ্চলে আধা-সামন্ততান্ত্রিক কৃষি উত্পাদন ব্যবস্থা বজায় ছিল। আবার
ঐতিহাসিকরা উনিশ শতকের নবজাগরণ নিয়ে মৌলিক কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেন। পরবর্তী সময়
সাব-অল্টার্ন গোষ্ঠীর উদ্যোক্তা রণজিত্ গুহ এবং তাঁর সঙ্গে সুমিত সরকার ও অশোক সেন
এই ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রধান ছিলেন। তাঁরা রামমোহন, বিদ্যাসাগর
প্রমুখ মনীষীর বিভিন্ন সংস্কার কার্য নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। কারণ এসব মনীষী
ঔপনিবেশিক ভারতের ক্ষমতা বিন্যাস নিয়ে কোনো প্রশ্ন না তুলে সেই ক্ষমতাবিন্যাসের
কাঠামোকে অবলম্বন করেই সামাজিক প্রগতির কথা বলেছেন। তাঁদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া
অনিবার্য। ভারতের বামপন্থী রাজনীতির আরেকটি বিতর্ক ছিল ১৯৬৭ সালে নকশালবাড়ী কৃষক
সংগ্রাম ও আন্দোলন নিয়ে। ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে এই রাজনৈতিক সংগ্রাম শেষ হলেও তার
প্রভাব অনেক দিন ধরে সমাজ, ইতিহাস, সাহিত্য,
সংস্কৃতিতে লক্ষ করা যায় এবং অনেক দিন ‘নকশাল আন্দোলন’ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। এই আন্দোলন ‘স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থায় ক্ষমতাবিন্যাসের প্রশ্নটি জাতীয় রাজনীতির
মঞ্চে এমনই নাটকীয়ভাবে উপস্থিত করতে পেরেছিল যে সেই প্রশ্নটিকে উপেক্ষা করা ছিল
অসম্ভব।’ ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইতিহাস নিয়ে এই সব অসম্পূর্ণ বিতর্কের
পটভূমিতে ওই ক্ষমতাবিন্যাসের প্রশ্নটিকে নতুনভাবে তুলে ধরলেন সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ
গোষ্ঠী। এই পরিপ্রেক্ষিতের সূত্র ধরে ‘সাব-অল্টার্ন
স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর ইতিহাস সম্পর্কে গৌতম ভদ্রের বক্তব্য হলো— কোনো আদিকল্পের বিবর্তনে অর্থাত্ ভারতের সত্তরের দশকে কৃষক
বিদ্রোহ, সিপিআইএমএল, নকশাল আন্দোলন
ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় ইতিহাস এবং সমাজবিজ্ঞানের গবেষণা নিয়ে অনেকেই নতুন
করে ভেবেছেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কলকাতার একদল তরুণ গবেষক, যার
মধ্যে অজিত চৌধুরী ছিলেন, তাছাড়া সুমেন্দু দাশগুপ্ত, পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং গৌতম ভদ্র ছিলেন— এঁরা সবাই মিলে একটা পত্রিকা বের করেন, তার
নাম ‘অন্যঅর্থ’। ‘অন্যঅর্থ’-এর একটা সংকলনও গত ৪-৫ বছর আগে বের হয়েছে। পুরো ‘অন্যঅর্থ’ ছাপা হয়েছে। তখন তাঁরা সকলে তরুণ গবেষক। গৌতম ভদ্র তখন ইউজিসি
ফেলো। তাতে তিনি ‘মুঘল যুগের কৃষি অর্থনীতি ও কৃষক বিদ্রোহ’-এর প্রথম খসড়াটা দেন। বন্যা নিয়ে, পানি নিয়ে
লেখালেখি শুরু হয়। অজিত চৌধুরী বুর্জোয়াজি অর্থনীতির একটা ধারাবাহিক সমালোচনা
করেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বুর্জোয়াজি পলিটিক্সের পলিটিক্যাল থিয়োরির একটা লেখা
দেন। এগুলো প্রাথমিক কাজ; অন্য ধাঁচের একটা গবেষণার কাজ।
এছাড়া ‘অন্যঅর্থে’র সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীতপন্থী কিছু লোকও যুক্ত ছিলেন। তবে ‘অন্যঅর্থে’র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো হিতেশরঞ্জন সান্যালের। তিনি অকালে প্রয়াত
হয়েছেন। তাঁর ‘স্বরাজের পথে’ একটি অসাধারণ বই। যেখানে গ্রাম-গঞ্জের মানুষরা স্বরাজ বলতে কী
বুঝেছিল তার প্রাথমিক বিবরণ পাওয়া যায়, যা আজও অতুলনীয়। সে
বইটারও ধারাবাহিক কিছু অংশ ‘অন্যঅর্থে’ প্রকাশিত হয়। কাজ এভাবে শুরু হয়। ইতোমধ্যে কিছু তরুণ গবেষক
যারা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাদের অনেকেই বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতে
যান। অন্যদিকে পঁচিশ বছর বাদে গান্ধীর ওপর কাজ করতে ভারতে আসেন রণজিত্ গুহ এবং ঐ
তরুণ গবেষকরা ব্রিটিশ প্রয়োগবাদী ইতিহাসের ধারণাতে বিশেষ বিরক্ত হন। রণজিত্ গুহ
তখন ইংল্যান্ডে। তাঁর পুরনো লেখার অনেকেই ভক্ত ছিলেন। তারা গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করেন।
তিনি তাঁদের সাথে আলোচনায় বসেন। বিদেশে থাকলেও রণজিত্ গুহ দেশজ ভাষায় কী ধরনের
লেখা হচ্ছে তার খবর রাখতেন। ‘অন্যঅর্থ’ প্রসঙ্গে তাঁর আগ্রহ ছিল। ইতোমধ্যে ফ্রন্টিয়ারে তাঁর দুটো খুব
বিখ্যাত লেখা বের হয়। ‘On structure, on culture’, `Neel-Darpon:The image of a Peasant Revolt in a Liberal Mirrow’।
রণজিত্ গুহ ‘সাব-অল্টার্ন
স্টাডিজ’ পরিকল্পনা নিয়ে ভারতে আসেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়, দীপেশ চক্রবর্তী, গৌতম ভদ্রের সাথে কথা বলেন। দেশজ
অনুসন্ধান আর বিদেশি গবেষণা— এ দুটো মিলিয়ে নিম্নবর্গের ইতিহাসের ধারা। লক্ষণীয়, তখন
যাঁরা এতে আসেন তখন একমাত্র পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও ডেভিড আর্নল্ড ছাড়া আর কারো
প্রায় ডক্টরেট ডিগ্রি হয়নি। রণজিত্ গুহ ও তাঁদের পার্থক্য তিনটি প্রজন্মের। রণজিত্
গুহ তিনটি প্রজন্মকে ডিঙিয়ে তরুণ গবেষকদের নিয়ে ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ প্রকল্প তৈরি করেন। পরে কিছুদিনের জন্য সুমিত সরকার যোগ দেন।
এই হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ তৈরি হবার আলোচনা।
উল্লেখ্য, প্রথম থেকেই এ গোষ্ঠীর তাত্ত্বিকের
সংখ্যা কম। Vivek Chibber ২০১২ সালে ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজে’র আদিপর্ব এবং তার গবেষণার মূল প্রকল্প নিয়ে আক্রমণ করে একটা বই লেখেন। তাতে
তিনি মূলত যে তিনজনকে অধ্যায় ধরে ধরে আক্রমণ করেছেন তারা হলেন রণজিত্ গুহ, পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও দীপেশ চক্রবর্তী। গৌতম ভদ্র, শাহিদ আমিনের নামোল্লেখ মাত্র সেখানে নেই। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক মাঝে
মাঝে উল্লেখিত হয়েছেন। সুতরাং মূল তত্ত্ব প্রসঙ্গে তাঁরা সবাই সচেতন, তবে তত্ত্বীয় কাঠামোর দিক থেকে রণজিত্ গুহ, পার্থ,
দীপেশ, গায়ত্রীর অবদান সবচেয়ে বেশি।
সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ আর এখন নেই। প্রত্যেক লেখকের নিজস্ব আলাদা বক্তব্য আছে। যেমন
পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিককালে যে তত্ত্বটা খুব আলোচিত সেটি হলো— ‘সিভিল সোসাইটি’ ও ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’। কী করে যারা গণতন্ত্রে নিধিরাম, যাদের নামে গণতান্ত্রিক অধিকার আছে কিন্তু আসলে গণতান্ত্রিক অধিকারের
প্রকরণগুলো যাদের অধিকারে নেই; তারা এই সিভিল সোসাইটি বা পৌর
সমাজের বাইরে গিয়ে ক্ষমতার কী কী ব্যবহার করতে পারে। দলিত রাজনীতি ও নারীবাদী
রাজনীতি যেটা পুরোপুরি সিভিল সোসাইটির প্রকরণ মানে না, আবার
সিভিল সোসাইটির প্রকরণকে তাদের মতো করে ব্যবহার করে গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে— এ সম্পর্কে নতুন চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে। এটা কিন্তু পুরোপুরি কৃষক
বিদ্রোহ বা শ্রমিক বিদ্রোহ নয়। অবস্থার হঠাত্ হঠাত্ গণবিক্ষোভ। সেগুলোকে পার্থ
চট্টোপাধ্যায় ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’ নাম দিয়েছেন তাঁর The Black Hole of Empire: History of
a Global Practice of Power, The Politics of the Governed: Reflections on
Popular Politics in most of the world political society প্রভৃতি
বিখ্যাত বইয়ের মধ্য দিয়ে। দীপেশ চক্রবর্তীর সম্প্রতি বাংলা বই যেটা বহুল প্রচারিত ‘ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ পাঠ করলে দেখতে পাওয়া যায়, তিনি কিভাবে
প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের ইতিহাস লিখছেন। পপুলার ইতিহাস, পিপল
হিস্টোরি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছেন এবং এনভায়রনমেন্ট হিস্টোরি, গ্লোবাল হিস্টোরির পরিপ্রেক্ষিতে বড় সময়, ছোট সময়
নিয়ে বিশ্লেষণ করছেন এবং আরেকটা বিশেষ আলোচনা হচ্ছে সাব-অল্টার্ন কালচার-
নিম্নবর্গের সংস্কৃতির সঙ্গে গ্লোকায়নের পরিপ্রেক্ষিতে mass কালচার
ও জনপ্রিয় কালচারের সম্পর্ক। কালচারাল স্টাডিজ সাব-অল্টার্ন কালচারের একটা বড় অংশ।
এছাড়া গণতন্ত্রের চরিত্র, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নানা দিকও
সাব-অল্টার্ন স্টাডিজে এসেছে। এ বিষয়গুলো নিয়ে নতুন কাজ হচ্ছে।
আগে যে রকম সাব-অল্টার্ন কালচার মূলত ছাপা টেক্সটের মধ্যে আবদ্ধ ছিল,
এখন নতুন নতুন গবেষকরা ভিজ্যুয়াল টেক্সট, প্রচ্ছদ,
অলংকরণ, ক্যালেন্ডার— এসব নিয়ে আলোচনা করছেন। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্ক কী?
পারস্পরিক সম্পর্ক কী? প্রতিবাদের-প্রতিরোধের— এইগুলো আলোচনা হচ্ছে। এ বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে এ গোষ্ঠীর তত্ত্বের আলোকে সাহিত্য বিশ্লেষণের বিষয়টি
সম্পর্কে আমরা মনে করি সাহিত্যের ক্ষেত্রে ভাষা চরম গুরুত্বপূর্ণ— যিনি লিখছেন তাঁরও ভাষা, যে বিষয় লেখা
হচ্ছে তারও ভাষা। ভর্তৃহরি, পাণিনি, শিবাজি,
সোসুর বারংবার মূল ‘সাব-অল্টার্ন
স্টাডিজে’র লেখকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। ভাষা প্রসঙ্গে কেবল গায়ত্রী স্পিভাক নন, অনেকেই অত্যন্ত সচেতন। ভাষার নানা রূপ নিয়ে ভাবা দরকার।
শব্দের অর্থ নিয়ে। প্রত্যেকটা শব্দের পেছনে অনেক সামাজিক বিনিয়োগ থাকে। সেটা
মুক্তবুদ্ধিও হতে পারে, যুক্তিও হতে পারে আবার মৌলবাদও হতে
পারে। মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই বলাটাই যথেষ্ট নয়। মৌলবাদ শব্দটা কী? মৌলবাদের প্রকৃতি কী? মৌলবাদ কি ধর্মীয়? সেকুলার জাতীয়তাবাদেরও মধ্যে মৌলবাদ থাকতে পারে। ভারতীয় সেকুলার
জাতীয়তাবাদে যেমন আছে। কমিউনিস্ট মৌলবাদরাও কী নৃশংস হতে পারে আমরা তা দেখেছি।
যুক্তিতেও একটা মৌলবাদ থাকতে পারে। এগুলো অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝেছি। আর এগুলো নিয়ে গত
২-৩ বছর কাগজে, পত্রপত্রিকায় সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের
ঐতিহাসিকদের লিখতে হয়েছে। আশীষ নন্দী তাঁর রচনায় এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন।
সেখানে অনেক তরুণ যাঁরা সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের বন্ধুস্থানীয় তাঁরা নতুন প্রশ্ন
তুলেছেন। তাই শব্দ, তার দৈনন্দিন ব্যবহার, দৈনন্দিন ব্যবহার থেকে নতুন অর্থে উত্তরণ এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে আমরা নিজেরাই নিজেদের শব্দের জালে বন্দি করে ফেলব। শব্দের
জীর্ণতায় দাসত্ব করব। তত্ত্বগতভাবে এটাই আমাদের মেনে চলতে হবে।
‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ ছিল একটা প্রকল্প। তার ১৩টি ভল্যুম বেরিয়েছে, তাতে কিছু ঐতিহাসিক তাদের গবেষণার ফল লিখেছেন। সেই ভল্যুম এখন বন্ধ। কাজ
গুটিয়ে গেছে। সাব-অল্টার্নিজম বা নিম্নবর্গীয়ত্ব একটা ধারণা। আগেই বলা হয়েছে
নিম্নবর্গ বলতে শ্রেণী বা গোষ্ঠী বোঝায় না। নিম্নবর্গ একটা সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের
নানা রূপ থাকে। গৌতম ভদ্রের মতে, সেই রূপ আজকে তিনটি
আন্দোলনে তিন প্রকারে আসতে পারে। তিনটে আধুনিক আন্দোলন নিম্নবর্গের ইতিহাসের
তত্ত্বকে, ক্ষমতার সম্পর্কের সহজ-সরল সমীকরণকে প্রশ্নবিদ্ধ ও
অনেক বেশি জটিল করেছে।
প্রথমত পরিবেশবাদী বিতর্ক। পরিবেশবাদীরা ধনতন্ত্রবাদকে আক্রমণ করেছে,
গোটা পরিবেশের প্রশ্নটি তুলে বিজ্ঞানের প্রগতির প্রশ্নকে চ্যালেঞ্জ
করেছে। আজকের বিশ্বায়নের বিতর্ক, সাম্রাজ্যবাদী পরিবেশের
প্রকল্প, বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশে তো বটেই, পাহাড়, স্থল মাইন ইত্যাদি নিয়ে বহুজাতিক সমস্যা,
সরকারি-বেসরকারি লাভ-ক্ষতি, ম্যাল্টিন্যাশনাল
কোম্পানির লোভ, সমস্ত জনসত্তার অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ
করেছে। ২০১৩ সালে ভারতের উত্তরাখণ্ডের বিশাল বন্যা, ঝড়,
সারা উত্তরাখণ্ডে Tourism Industry-র লোভ
ইত্যাদি দিয়ে হাজার হাজার মানুষের বেঁচে থাকাটা শারীরিকভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন
করেছে। আমরা জানি ব্রাজিলের আমাজনের বন কেটে ফেলার ফলে ব্রাজিলের জনগণ কিভাবে
রাস্তায় নেমে এসেছিল। এখন Human Species হিসেবে থাকাটা
সংকটজনক। এখানে বৈজ্ঞানিকরা বলতে শুরু করেছেন আসলে সমস্যাটা অনেক বড়। তত্ত্বের
সমস্যা ও সময়ের সমস্যা। যদি আমরা মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে বড়ভাবে দেখি পৃথিবীর
বিবর্তনের সঙ্গে, প্রাণের জন্মের সঙ্গে, তাহলে দেখব Industrial Revolution-এর সময় থেকে Geologist-রা বলছে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রগতি মানে প্রযুক্তির জয়। মানুষ প্রকৃতিকে
জয় করবে আগুন থেকে তেল, জ্বালানি সমস্ত নিয়ে। এ প্রযুক্তির
জয় যেটা মার্কসবাদে আছে কমপ্লিট প্রডাক্টিভিটি ফোর্স। সারা প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে।
প্রকৃতি ও মানুষকে ধ্বংস করছে। সেদিক থেকে শিল্পবিপ্লব প্রথম ধ্বংসের ঘণ্টা
বাজিয়েছে। অন্যদিকে ইতিহাস থেকে আমরা জানি ক্যাপিটালিজমের বিজয়বার্তা হচ্ছে Industrial
Revolution। আধুনিক
মানুষের জন্মের পিছনে Industrial Revolution-এর
বিখ্যাত ভূমিকা। ইতিহাসের চিন্তায় যেটা প্রগতির Geologist-এর
চিন্তায় সেটা ধ্বংসের। Geologist-এর কালের টাইমের ধারণার
সঙ্গে ইতিহাসের টাইমের সংঘর্ষ অনিবার্য। সাম্প্রতিককালে দীপেশ চক্রবর্তীর সাড়া
জাগানো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ফলে সাব-অল্টার্নিটির প্রশ্নটাই নতুন করে ভাবতে
হচ্ছে। স্পষ্টত environment-এর সঙ্গে ছোট ছোট গোষ্ঠীর বেঁচে
থাকার অধিকার জড়িত। এখানে নিম্নবর্গের অস্তিত্ব আবার গোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে নতুন
মাত্রা পেয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ফেমিনিস্ট বা নারীবাদী বিতর্ক।
অর্থাত্ জেন্ডার বা লিঙ্গ বা লৈঙ্গিক রাজনীতি বিতর্ক। এক্ষেত্রে সমকামী, উভকামীরাও এগিয়ে এসেছে। সেখানে সাব-অল্টার্নিটির ভূমিকা কী? এটাও ঠিক Patriarchal নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে
পুরুষতন্ত্র দিয়ে। আবার এটাও তো ঠিক পুরুষতন্ত্রের পুরুষ যতটা নিষ্পেষণ করে নিজেও
ততটাই নিষ্পেষিত হয়। পুরুষতন্ত্রের অত্যাচারী পুরুষ নিজেও তো মুক্ত মানুষ নয়।
নারীর মুক্তি তো কখনোই সম্ভব নয়, যদি পুরুষের মুক্তি না হয়।
ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রকৃতি লৈঙ্গিক রাজনীতির লড়াইয়ের প্রকৃতি
সমশর্তে প্রকৃতস্থ নয়। সেখানে সাব-অল্টার্নিটির ভূমিকা কী, সেটাই
ভাবার প্রশ্ন।
তৃতীয়ত, ভারত-বাংলাদেশের অনেক দলিত তাদের কথা
লেখার ভাষায় বলছে। আশীষ নন্দীর কাজ লক্ষ করলে তার প্রমাণ মেলে। দলিতদের রাজনীতি
আজকে খুবই বিতর্কিত। দলিতদের রাজনীতি কি দুর্নীতিগ্রস্ত? দলিতদের
গোষ্ঠী হিসেবে উত্থান, দলিতদের চেতনার স্বরূপ কী? তারা হঠাত্ ব্রাহ্মণদের লেখা পড়বে কেন? আজ ভারতজুড়ে
দলিতদের দাবি— বাংলা হঠাও, হিন্দি হঠাও, ইংরেজি আনো। এই যে আঞ্চলিক ভাষায় লেখাপড়া, এতে
দলিতদের আগ্রহ নেই। তাদের মতে এটা উচ্চবর্গের একটা চাল। নিজেরা অর্থাত্ উচ্চবর্গের
সন্তানেরা ইংরেজি শিখবে এবং দলিতদের আঞ্চলিক ক্ষমতায় ফেলে রাখবে। আজকে সর্বভারতীয়
স্থান পেতে হলে অম্বেদকারের মতো ইংরেজি শিখতে হবে। দলিত গ্রামে ইংরেজি দেবীর পূজা
শুরু হয়েছে। সারা ভারতে দলিতকে এক্কাট্টা হতে গেলে ইংরেজি ভাষা ছাড়া কোনো গত্যন্তর
নেই। এখানে ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজে’র ভূমিকা কী? ভাষার সঙ্গে সাব-অল্টার্নিটির
ক্ষমতার সম্পর্কটাই নতুনভাবে উন্মোচন করা হয়েছে। এসব জায়গায় নিশ্চয় নতুন করে ভাবার,
লড়াই করার, যাচাই করার দরকার।
৩.
মূলত, সাম্রাজ্যবাদী আর জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের
বিরোধিতার পথ ধরেই নিম্নবর্গের ইতিহাসের অগ্রযাত্রা। উচ্চবর্গ থেকে নিম্নবর্গের
রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর পদ্ধতির স্বাতন্ত্র্য এবং নিম্নবর্গের চেতনার নিজস্বতা
অন্বেষণই সাব-অল্টার্ন স্টাডিজের প্রাথমিক কাজ ছিল। এছাড়া এ গোষ্ঠী নিম্নবর্গের
ইতিহাস নির্মাণে নিুোক্ত কাজ করেছে—
ক. ঔপনিবেশিক ভারতের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা এবং আধুনিক সমাজ
প্রতিষ্ঠান গড়ার জটিল ইতিহাসের দলিলসমূহ অন্যদৃষ্টিতে পাঠ।
খ. ব্রিটিশ শাসনযন্ত্রের প্রসার, ইংরেজি
শিক্ষার বিস্তার, নবজাগরণের উদ্ভব, সর্বোপরি
জাতীয়তাবাদের উন্মেষ প্রভৃতির ইতিহাস অন্বেষণ ও পুনর্বিবেচনা।
গ. কেবল নিম্নবর্গের স্বতন্ত্র ক্রিয়াকলাপের বিবরণে সীমাবদ্ধ না
থেকে সমগ্র সমাজ প্রতিষ্ঠান, ভাবাদর্শের জগেকই নিম্নবর্গের
দৃষ্টিতে দেখা। ঔপনিবেশিক আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রে ও স্বাধীন ভারতে যেসব প্রতিষ্ঠান
নতুন জ্ঞান-বিজ্ঞান সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট হয়েছিল সেসব প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে
স্কুল-কলেজ, সংবাদপত্র, প্রকাশনা
সংস্থা, হাসপাতাল ডাক্তার, চিকিত্সাব্যবস্থা,
জনসংখ্যাগণনা, রেজিস্ট্রেশন, লাইসেন্স, আধুনিক শিল্প উত্পাদনে দৈনন্দিন শ্রম
সংগঠন, বিজ্ঞান সংস্থা, গবেষণাগার
প্রভৃতির বিশদ ইতিহাস অন্বেষণ।
ঘ. প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সামাজিক রাজনৈতিক
কর্মসূচি এবং ক্রিয়াকলাপ বিশ্লে¬ষণ ও সমালোচনা করা। অর্থাত্
যেকোনো প্রতিষ্ঠিত বা প্রতিষ্ঠায় অভিলাষী ক্ষমতাতন্ত্রের সমালোচনা এ গোষ্ঠীর
আলোচনায় সম্ভব হলো।
ঙ. প্রতিষ্ঠিত জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠীদের পারস্পরিক
বিতর্কে নিম্নবর্গের রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ প্রযুক্ত।
চ. আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অঙ্গীভূত এবং রাষ্ট্রক্ষমতা বিস্তারের
কৌশলে সেক্যুলার/ কমিউনাল বিবাদ/ বিতর্ক এবং শোষিত, দরিদ্র
হলেই সামপ্রদায়িকতাবিরোধী ও সেক্যুলার রাজনীতির সমর্থক হবে— এ ধারণার ভুল ভেঙে দিয়ে আলোচনা।
ছ. জাতিভেদপ্রথা বিশ্লেষণে এ গোষ্ঠী দেখিয়েছে কিভাবে ধর্মীয় ভিত্তি
লুপ্ত হয়ে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিভিন্ন গোষ্ঠীর অবস্থান গুরুত্ব পাচ্ছে।
নিম্নবর্গ সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্নভাবে এই
ক্ষমতাতন্ত্রের একদিকে বিরোধিতা করছে অন্যদিকে আবার সুযোগ নিচ্ছে। উচ্চবর্গের
আধিপত্য বিস্তারের কৌশল এই জাতিগত পরিচয়ে নিহিত।
জ. পুরুষ চালিত সমাজে নারী নিম্নবর্গ। এ সমাজে নারীর অধীনতা বা
ক্ষমতার সম্পর্কের ভিত্তিতে নারীর নির্মাণ এবং নিম্নবর্গের নারীর অধীনতাকে পৃথক
করে চিহ্নিতকরণ।
ঞ. ভারতের রাষ্ট্রযন্ত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বিংশ শতাব্দীর বেশি
সময় ধরে চর্চিত উচ্চবর্গের রাজনীতির বিরোধিতা করা।
বস্তুত ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর লেখকরা নিম্নবর্গের নিজস্ব ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ
করেছেন। ইতিহাস অবশ্য ব্যক্তিগত কারো নয়। নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ইতিহাসও হয় না,
এ জন্য নিম্নবর্গের ইতিহাস অসম্পূর্ণ, পরিবর্তনশীল।
তবে এই ইতিহাস ‘অবদ্ধ ও সচল’। নিম্নবর্গের সংগ্রামের যথার্থ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার জন্য এখনো এ ইতিহাসচর্চা
চলছে। প্রকৃত ইতিহাস উচ্চ/নিম্নবর্গের মিলিত জীবন ও সংগ্রাম; একে অপরের সম্পর্কে নির্মিত হয়। এ কারণে রণজিত্ গুহ
উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের রাজনীতির বেণিবন্ধনের কথা বলেছেন— ‘…ঔপনিবেশিক যুগের রাজনীতির ক্ষেত্রটি দ্বিধাবিভক্ত। কিংবা
অন্য উপমায় বলা যায় যে, উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের চৈতন্য ও
কর্মের বাহন দুটি স্বতন্ত্র ধারা বয়ে চলেছে ওই রাজনীতির মধ্যে। তবে সেই সঙ্গে এ
কথাও বেশ জোর দিয়েই বলা দরকার যে স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও ওই ধারা দুটি পরস্পর
নিরপেক্ষ নয়। নিরপেক্ষ নয় তাদের বৈপরীত্যের জন্যেই। বিপরীত বলেই যেকোনো দ্ব্যণুক
সম্বন্ধের রাশি দুটির মতো তাদের একটি অপরটির অস্তিত্ব সূচনা করে, ঘোষণা করে।’ উচ্চবর্গের উদ্যোগ থেকে নিম্নবর্গের উদ্যোগ স্বতন্ত্র, মতাদর্শের বাইরে তার কর্মকাণ্ড। অথচ এই উভয় বর্গ একত্রিত সমাবেশে মিলতে
চেয়েছে। উচ্চবর্গের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের উপলক্ষে বিরাট সমাবেশে
হাতিয়ার হিসেবে নিম্নবর্গ কাজ করেছে। কিন্তু নেতাদের আপসের মনোবৃত্তি, প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা, জঙ্গি গণ-আন্দোলন ভীতি
এবং সর্বোপরি নিম্নবর্গের চৈতন্যের নানা সীমাবদ্ধতা এই সম্মিলিত আন্দোলনকে স্থায়ী
হতে দেয়নি। আন্দোলনে স্থবিরতা আসলে বেণিবন্ধ শিথিল হয়ে পড়েছে। ফলে আবার রাজনীতির
স্বতন্ত্র ধারা অব্যাহত থেকেছে। এ জন্যই উচ্চবর্গ ইতিহাসকাঠামো থেকে বের হয়ে আসার
প্রস্তাব দেয় ‘সাব-অল্টার্ন স্টাডিজ’। উচ্চবর্গ-নিম্নবর্গের মধ্যেকার বৈপরীত্য ও সম্পৃক্তি যথাযথভাবে বর্ণনা করতে
হবে এবং একারণেই ইতিহাসে নিম্নবর্গের ভূমিকাকে যথার্থ গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরতে
বলেন এ গোষ্ঠীর লেখকরা। আর এখানেই ‘সাব-অল্টার্ন
স্টাডিজ’ গোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্য; বিশ্ব
জ্ঞানকাণ্ডের একটি বিশিষ্ট সংযোজনাও।
সহায়ক গ্রন্থ
গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় (সম্পাদক), নিম্নবর্গের
ইতিহাস, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স
প্রা. লি. ১৯৯৯
মিল্টন বিশ্বাস, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ছোটগল্পে নিম্নবর্গের মানুষ, ঢাকা, বাংলা
একাডেমি, ২০০৯
Antonio Gramsci, Selections from the Prison Notebooks (1971), edited and trans.
: Quintin Hoare
Geoffrey Nowel Smith, India, Orient Longman, 1996
Ranajit Guha, Subaltern Studies (I-VI), Delhi, Oxford University Press,
1982-1989