বৃহস্পতিবার, সকাল ১০:১৩ ২৫শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
ব্যক্তির বিচার হলে দলের কেন নয়?
/ ৩২১ বার
আপডেট : বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকরের (৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬) মধ্য দিয়ে জাতি আরেক ধাপে কলঙ্ক মুক্ত হয়েছে। মীর কাসেম ছিল জামায়াতে ইসলামীর সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম মজলিসে শুরার সদস্য, দলটির অর্থ জোগানদাতা হিসেবেই সে পরিচিত। চট্টগ্রামের ডালিম হোটেলে নির্যাতনের ‘কৃতিত্বের’ প্রেক্ষাপটে একাত্তরের শেষ দিকে ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল তাকে।

স্বাধীন বাংলাদেশে নতুন করে আবার ছাত্র সংগঠনের যাত্রা শুরুতে তার ওপরই ভরসা করতে দেখা যায় জামায়াত নেতৃত্বকে। স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযোগ পায়। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্রশিবির যাত্রা শুরু করলে তার সভাপতি হয় সে। তারপর ঘটতে থাকে মীর কাসেমের উত্থান, যা তাকে এতটাই উদ্ধত করেছিল যে রায়ের পরপরই এই জামায়াত নেতার প্রতিক্রিয়ায় তার প্রকাশ ঘটে।

অন্যদিকে তার রায়ের আপিল নিষ্পত্তির পর জামায়াতে ইসলামী ৩১ আগস্ট (২০১৬) সারা দেশব্যাপী হরতাল দিয়ে তাদের নেতার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। পাকিস্তান সরকার মীর কাসেমসহ জামায়াতে ইসলামীর অন্যান্য কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি যে সহানুভূতি ও সমর্থন দেখিয়েছে তাতে বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে জামায়াতে ইসলামী দল এবং তার নেতারা চিহ্নিত হয়েছে স্পষ্টভাবে। এজন্য মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে সংগঠন হিসেবে ‘জামায়াতে ইসলামী’র বিচার করা নিয়ে কোনো বিতর্ক আছে বলে আমরা মনে করি না।

২.
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণে দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রসংঘের সদস্যরা যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত। উপরন্তু জামায়াতে ইসলামী কিংবা ছাত্রসংঘের নেতাদের বিচারের মুখোমুখি হওয়াটা স্বাভাবিক এ কারণে যে দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিল।

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে সবই এখন স্পষ্ট। ৮ মার্চ (২০১৬) সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ে সাজা বহাল থাকায় একাত্তরের বদর নেতা মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হল। এই ব্যক্তি জামায়াতে ইসলামীর পঞ্চম শীর্ষ নেতা, চূড়ান্ত রায়েও যার সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত ঘোষিত হয়।

আপিল বিভাগে যুদ্ধাপরাধ মামলায় এর আগের ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটিতে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, দলটির সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। আপিল বিভাগের আরেক রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

সেই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই পক্ষের করা রিভিউ আবেদন এখন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। আর সর্বশেষ রায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর সর্বোচ্চ সাজা বহাল রেখেছিল আপিল বিভাগ। ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হলে দণ্ড কার্যকর করা হয়।

শুনানি চলার মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমির গোলাম আযম ও বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের মৃত্যু হওয়ায় তাদের আপিলের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য, জামায়াত আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের পর মীর কাসেম ছিল আলবদর বাহিনীর তৃতীয় প্রধান ব্যক্তি। তার যোগানো অর্থেই স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী পেয়েছে শক্ত ভিত্তি। 

২০১০ সালের ২৯ জুন জামাতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে গ্রেফতার করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য শুরু হয়। একইদিন যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬ ডিসেম্বর সাকা চৌধুরী গ্রেফতার হয়। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি জামাতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

২৩ সেপ্টেম্বর একই অভিযোগে মাওলানা আবদুস সোবহানকে আটক করেন আদালত। ২০১৩ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে গতিশীল কার্যক্রমের বছর। এসময় ২১ জানুয়ারি গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামাতে ইসলামীর পলাতক নেতা আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

৫ ফেব্রুয়ারি জামাতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। যদিও পরে আপিলে তাকে মৃত্যুণ্ড দেয়া হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি একইদলের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। অবশ্য পরে আপিলে এই অপরাধীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

৯ মে জামাতে ইসলামীর অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ১৭ জুলাই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

১ অক্টোবর একই অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল-১। অন্যদিকে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

২০১৫ সালের ২ ডিসেম্বর যুদ্ধাপরাধের মামলায় দোষ স্বীকার করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামাতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর সাজা কমানোর আবেদন করেন তার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন। ৩০ ডিসেম্বর জামাতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির রায় ঘোষিত হয়। ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জামাতে ইসলামীর নায়েবে আমির আবদুস সোবহানকে ফাঁসির আদেশ দেন যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

একইদিন কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামাত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। ২০১৫ সালের ৯ জুন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরগঞ্জের তাড়াইল থানার রাজাকার কমান্ডার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলী ওরফে হাছেন আলীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

২০১৫ সালের ১৬ জুলাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে পটুয়াখালীর রাজাকার ফোরকান মল্লিককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। ২০১৫ সালের ১২ আগস্ট একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা-গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন এবং শতাধিক বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বাগেরহাটের কসাই রাজাকার কমান্ডার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারকে মৃত্যুদণ্ড ও খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড প্রদান করেন ট্রাইব্যুনাল।

২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর দিবাগত রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও আলবদর কমান্ডার জামাত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নেত্রকোনোর দুই রাজাকার ওবায়দুল হক ওরফে তাহের ও আতাউর রহমান ওরফে ননীকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে আমাদের দেশের ভয়ঙ্কর দানব জামায়াতে ইসলামীর নৃশংসতার কথাই বারবার মনে আসছে। কারণ তাদের ইতিহাস কলঙ্কিত ইতিহাস; তাদের অতীত কলুষতায় পূর্ণ। ১৯৪৭ সালের পর থেকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জামাত বারবার নিষিদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও একে নিষিদ্ধ করেছিলেন।

৩.
একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ হলো একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীবৃন্দ এবং জামাতে ইসলামী ও ছাত্র সংঘ। কারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় প্রদান করার সঙ্গে সঙ্গে হরতাল ও নাশকতা সৃষ্টিতে মেতে ওঠে জামাত ও তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র-শিবির। এমনকি জামাতের যেকোনো অপরাধী নেতাকে গ্রেফতার করার পর তারা হরতাল পালন করেছে একাধিক দিন। অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াশীল, মৌলবাদী ও ক্যাডারভিত্তিক জামাত-শিবির সংগঠনের নেতাকর্মীরা যুদ্ধাপরাধীদের রায়ের পর দেশের মধ্যে তাণ্ডব চালিয়ে অনেক পুলিশসহ সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে।

অথচ গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী-মীর কাসেমদের সমর্থক নতুন প্রজন্মদের এখনই জামাতের কবল থেকে বের হয়ে সুস্থ চিন্তায় নিজেদের গড়ে তোলার সুযোগ রয়েছে। যারা এতদিন নেতা হিসেবে তাদের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে আদেশ পালন করে রগ কেটে বোমা-গ্রেনেড মেরে মুক্তবুদ্ধির মানুষদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছে তাদের এখন বুঝতে হবে এসব বড় বড় অপরাধীদের পেছনে নিজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করা বৃথা।

তাদের সেই সব ধর্মপ্রাণ (?) নেতারা এখন মৃত অথবা ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিশ্চয় সমর্থকদের নজরে এসেছে। অপরাধগুলো ভয়াবহ। জামাতের নেতারা কখনো বাংলাদেশ চায়নি; তাই মুক্তিযুদ্ধের পরও তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এসব মানুষ পাকিস্তান ও ইসলামের নামে বাঙালি জাতিকে চিরতরে অন্ধকারে নিক্ষেপ করতে চেয়েছিল; তারা ধর্ষণ ও নির্মম হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা, প্ররোচনা এবং অনেক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে একাত্তরের নয় মাস আমাদের পবিত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে কাজ করেছে।

আমাদের অকুতোভয় মুক্তিসেনাদের দৃঢ়তায় তাদের সব প্রচেষ্টাই ভেস্তে যায়। দেশ স্বাধীন হয়। আর দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই জামাত ও ছাত্রসংঘের সদস্যরাও আজ নিজেদের শিক্ষিত করার সুযোগ পেয়েছে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছে। মীর কাসেমের মতো অনেকেই নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জামাত নেতাদের পেছনের ইতিহাস সকলের জানা। অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি ১৯৭১ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকেই দেশের মধ্যে গণহত্যা, বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার জন্য আল-বদরদের দায়ী করে বিচারের দাবি করা হয়। একই বছর ২৫ ডিসেম্বর বেগম সুফিয়া কামাল ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনসহ ৫২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচার দাবি করেন। ২৮ ডিসেম্বর (১৯৭১) ১৩ জন লেখক শিল্পী ও আইনজীবীর যুক্ত বিবৃতিতে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যায় যোগসাজশকারীদের খুঁজে বের করার আহবান ছিল।

১৯৭২ সালে কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকা ‘শহরে বিক্ষোভ সভা ও মিছিল’হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ ৫ জুন ১৯৭২ সালে ঘোষণা করেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে। হত্যার তথ্য সংগ্রহে উদ্যোগী ভূমিকা পালনকারী কথাসাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান নিখোঁজ হলে দাবির আন্দোলন কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তবে বুদ্ধিজীবী হত্যার তদন্ত দাবি করে ১৯৭২ সালের ৭ মার্চ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারবর্গ শহীদ মিনারে গণজমায়েত করেছিলেন এবং মিছিল করে বঙ্গভবনে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

ঘটনা তদন্তের নির্দেশ প্রদানের কথা জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হলেও ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে ৩৭ হাজার ৪৭১ জন বাঙালি-বিহারি দালালকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭২ সালেই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদেশ জারি করা হয়েছিল। সে সময় ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২ হাজার ৮৪৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়।

অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত হয়, ২ হাজার ৯৬ জন ছাড়া পায়। তবে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকায় ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বরের দালাল আইনে আটক কিছু ব্যক্তিকে বঙ্গবন্ধু সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর হন্তারক খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে সাজাপ্রাপ্তসহ সবাইকে ক্ষমা ও খালাস করে দেন। জিয়ার নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাচ্যুতির পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যৌক্তিক দাবি আবার উত্থাপিত হয়।

১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জাহানারা ইমামকে সভাপতি করে ১২ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘গণআদালত’এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্মরণাতীতকালের বিশাল সভায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষণা করা হয়। বেগম খালেদা জিয়ার সরকার গণআদালতের সঙ্গে জড়িত ২৪ জনকে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় জড়িয়ে দেয়; নাজেহাল করা হয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ব্যক্তিবর্গকে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে পাকিস্তানবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির যে তৎপরতা শুরু হয়েছিল তারই অনিবার্য ফল হচ্ছে বিএনপির মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান।

রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের অপরাজনীতি শেকড় গেড়ে বসে। উল্লেখ্য, ক্ষমতা গ্রহণের পর জেনারেল জিয়া ১৯৭৬ সালে জামাত-শিবিরের রাজনীতি উন্মুক্ত করতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন (বিশেষ অধ্যাদেশ ৪ মে ১৯৭৬ এবং বাংলাদেশ সংবিধান, ৫ম সংশোধনী, ২২ এপ্রিল ১৯৭৭)। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের জামাতের অপরাজনীতি শুরু হয় এবং ‘ইসলামী ছাত্রসংঘে’র কতিপয় নেতা ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ সালে ঢাকায় সমবেত হয়ে পরিবর্তিত নাম ‘ইসলামী ছাত্রশিবির’ধারণ করে নতুনভাবে কর্মকাণ্ড শুরু করে।

এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের মতো বাংলাদেশকে পরিচালনা করা। এ লক্ষ্যে শিবির দেশের ছাত্র ও যুবসমাজের মধ্যে গভীরভাবে প্রবেশের পরিকল্পনা করে। মীর কাসেম ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয় এবং ১৯৮০ সালে সরাসরি জামায়াতের রাজনীতিতে যোগ দেয়।

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে ১৯৮৩ সালে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড গঠন হলে এই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-চেয়ারম্যান ছিল। দলে দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে ১৯৮৫ সালে হয় জামায়াতের শুরা সদস্য। ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত মীর কাসেম দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনেরও চেয়ারম্যান ছিল। ওই প্রতিষ্ঠানেরই সংবাদপত্র ‘দৈনিক নয়াদিগন্ত’এবং টেলিভিশন চ্যানেল ‘দিগন্ত টেলিভিশন’। ঢাকায় হেফাজতে ইসলামের অবস্থান নিয়ে ধর্মীয় উসকানি দেওয়ার অভিযোগে ‘দিগন্ত টেলিভিশন’এখনও বন্ধ।

৪.
যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি সংগঠন হিসেবে জামাতের বিচারে ট্রাইব্যুনালের বর্তমান আইনে কোনো বাধা নয়। ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত জামাতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় রায় হয়েছে। এসব রায়ের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে জামাতকে অপরাধী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধন করা হয়েছে। এর সূত্র ধরে তদন্ত সংস্থা জামাতের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। গত ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ প্রসিকিউশনের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। আমরা সকলে জানি, জামাত বাংলাদেশে বিশ্বাস করে না। সকলের প্রত্যাশা তারা যেন এ দেশে রাজনীতি করতে না পারে। উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন-১৯৭৩-এর ২০(২) ধারায় অপরাধী ব্যক্তির শাস্তি কী হবে, তা উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু অপরাধী কোনো সংগঠনের শাস্তি কী হবে তা বলা নেই। তবে আইনে বলা আছে, অপরাধ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল যেরূপ মনে করে, সেরূপ শাস্তি দিতে পারবে। আইনের এই ধারার সুযোগে ট্রাইব্যুনালের বিচারে দোষী যেকোনো সংগঠনকে শাস্তি দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে নজির হিসেবে নুরেমবার্গ ট্রায়ালের আদেশ অনুসরণ করা যেতে পারে বলে মনে করেন অনেক আইনজ্ঞ।

আইনি জটিলতা ও অস্পষ্টতাকে সরিয়ে জামাত-শিবিরের নৃশংসতা থেকে আমাদের নিরাপদ করতে তাদের অপরাধ বিষয়ে বিচার সম্পন্ন করা জরুরি। এ কারণে, আমাদের জিজ্ঞাসা ব্যক্তির বিচার হলে দলের বিচার কেন নয়?
সূত্র: পরিবর্তন.কম।
ড. মিল্টন বিশ্বাস: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। 
writermiltonbiswas@gmail.com  

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Total Post : 31