‘ডাকসু’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ২৮ বছর পর আগামী ১১ মার্চ। স্বাভাবিকভাবে ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গটি গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচ্যসূচি হয়ে উঠেছে। বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে নতুন নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ ছাত্র রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার একটি প্রবন্ধে ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য সম্পর্কে লিখেছেন, ‘ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানে নিজেকে গড়ে তোলা’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র ১, পৃষ্ঠা ১৭৯)। এ জন্য তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার উপযুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন ১৯৯৪ সালে। তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমরা শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাসের বিরোধী।’ বর্তমান শতাব্দীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ নির্মাণে নতুন প্রজন্মের সাহসী সৈনিকরা অনেকেই নেতৃত্বে এগিয়ে এসেছেন। আর জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগোপযোগী নেতৃত্বের কারণে দেশ এগিয়ে চলেছে। ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে শিক্ষা, পরে রাজনীতি।’ গত ১০ বছরে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তিনি।বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশের কারণ ছিল প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের কাছে প্রত্যাশা করেন অনেক। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণ ভোটারদের কথা তার মনে আছে। এ জন্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে তিনি ‘এগিয়ে যাচ্ছে দেশ’ ইশতেহারটিও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা তরুণদের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারেও তিনি তরুণ সমাজকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তার প্রত্যাশা ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তব। দেশকে এগিয়ে নিতে চান তিনি। বাংলাদেশের মানুষ ভালো থাকুক, সুখে থাকুক, উন্নত জীবন পাকÑ এটিই তার প্রত্যাশা। তাই ছাত্র সংগঠন রাজনীতির নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে উন্নয়নের অনেক অন্তরায়ের মধ্যে একটি হলো নোংরা ছাত্র রাজনীতি। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ছাত্রদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াসহ জাতীয় ইস্যুতে সোচ্চার হওয়ার চেয়ে নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। এই প্রবণতা থেকে ছাত্রদের মুক্ত করতে পারে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। জননেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে পাকিস্তান আমলে ‘ইডেন মহাবিদ্যালয় ছাত্রী সংসদ’ নির্বাচনে ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসেবে নন, ওই সময় তার মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সাধারণ ছাত্রীদের মন জয় করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। এটি ছিল আদর্শের জয়। এই আদর্শভিত্তিক সংগঠন ছাত্রদের পথপ্রদর্শক হতে পারে।অবশ্য ২৫ বছর আগে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ছাত্রদের দিয়ে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার চিন্তা করেছেন। ১৯৯৪ সালে তার লিখিত ‘শিক্ষিত জনশক্তি অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত’ শীর্ষক প্রবন্ধে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাস্তবমুখী করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। দেশের উৎপাদনমুখী কর্মকা-ের সঙ্গে শিক্ষিত যুবক-যুবতীদের যথাযথভাবে সম্পৃক্ত করাই তার লক্ষ্য ছিল। প্রত্যেক ছাত্র যাতে নিজস্ব স্বাভাবিক মেধা-মনন, ক্ষমতা ও প্রবণতা অনুযায়ী পেশা বেছে নিতে পারে, এ জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। ওই সময় তার প্রত্যয়দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল, ‘শিক্ষাঙ্গনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।’এ কথা সত্য, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ছাত্র রাজনীতির রূপ পাল্টেছে। ২০১৯ সালের ছাত্র এবং ষাটের দশকের ছাত্র রাজনীতি কখনই এক নয়। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পর ছাত্র রাজনীতি এবং বর্তমানের রাজনৈতিক বাস্তবতার রাজনীতি একেবারেই ভিন্ন। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ছাত্রসংখ্যা এবং বর্তমানে ছাত্রসংখ্যার মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিবুর রহমান তার ছাত্রজীবনে রাজনীতি করার নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। ২২ বছর বয়সে তার একটি উল্লেখযোগ্য মন্তব্য ছিল এরকমÑ “কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। দিনরাত রিলিফের কাজ করে কূল পাই না। আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, ‘বাবা, রাজনীতি করো আপত্তি করব না। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এ তো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখো, ঝরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।’ এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই” (পৃষ্ঠা ২১)। শেখ মুজিব ছাত্রজীবন থেকে দেশের কাজ করার জন্য জেল খেটেছেন, জনসাধারণের আত্মিক বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন কেবল নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। কখনো লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষকরা তাকে স্নেহ করতেন। কলেজের অ্যাসেম্বলি হলের দরজা খুলে যখন ইচ্ছা সভা করতেন। প্রিন্সিপাল দেখেও দেখতেন না। ওই সময় তিনি একই সঙ্গে মুসলীম লীগ ও ছাত্রলীগে কাজ করেছেন। আমরা সবাই জানি, দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছিলেন সাধারণ মানুষের কাছের জন হিসেবে। এ জন্য নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের পক্ষাবলম্বন করে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। ওই বহিষ্কারাদেশ বর্তমান উপাচার্য প্রত্যাহার করেছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হলে বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলার মানুষকে শোষণ করে গোলামে পরিণত করার স্বাধীনতা এসেছে। ওই বছরই কলকাতার পার্ক রোডের সিরাজউদ্দৌলা হোস্টেলে ঘরোয়া বৈঠক করে সহকর্মীদের বলেছিলেন, ‘আমরা শেষ হয়ে গেছি। নতুন সংগ্রাম শুরু করতে হবে।’ কলকাতা থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় এসে শপথ নিয়েছিলেন বাংলার মানুষকে মুক্ত করার। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ওই সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠন করে আন্দোলন শুরু হলে সেদিন সকালেই তিনি গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানি জুলুমের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর সাহসী কর্মকা- এখন পর্যন্ত এ দেশের ছাত্রসমাজের রাজনৈতিক জীবনের পাথেয়। তার আদর্শিক পথ থেকে আমরা বুঝেছি, মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতি করলে জনগণকে নিয়ে কথা বলতে হয়। এ জন্য সবাইকে জনগণের ভাষা বুঝতে হবে। জাতিকে সত্য বলার জন্য রাজনীতিবিদরাই পারেন উদ্বুদ্ধ করতে। কেননা রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটেছে ছাত্র রাজনীতির হাত ধরে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত নেতৃত্ব প্রদানকারী বড় নেতারা সবাই ছাত্র রাজনীতি থেকে উঠে আসা। ছাত্র রাজনীতির গোড়ার ইতিহাস বর্ণাঢ্য, গৌরবোজ্জ্বল ও ঐতিহ্যবাহী। ষাট-সত্তরের দশকের ছাত্র রাজনীতি ছিল সাহিত্যনির্ভর, তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন। দলের মধ্যে স্বাধীন চিন্তা ও ভিন্নমত পোষণ করার মতো অনুকূল পরিবেশ ছিল। ছাত্র রাজনীতির প্রভাব তখন সুদূরপ্রসারী হওয়ায় জাতীয় রাজনীতি প্রবলভাবে প্রভাবিত হতো। এ জন্যই ছাত্রলীগ নেতারা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনায় বসতেন। তিনিও নিবিষ্টচিত্তে আলোচনা করতেন। তখন রাজনৈতিক অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বাধীনতা ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্রদের ভূমিকা ছিল অগ্রণী। ১৯৯০ সালে এরশাদ আমলে ছাত্ররা রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গদল হিসেবেই গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অভূতপূর্ব অবদান রাখে। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে যারা স্বাধীনতার আগে থেকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে একত্র হয়েছিলেন, তাদের অনেকেই এখনো জীবিত। তারা বর্তমান ছাত্র রাজনীতির কর্মকা- নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। মাঝে মধ্যেই তারা তাদের দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন। কারণ তাদের দৃষ্টিতে বর্তমান ছাত্র সংগঠনগুলোর আদর্শ নেই, নীতি-নৈতিকতা অনুপস্থিত।অবশ্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। এ দেশের ইতিহাসে আওয়ামী লীগই প্রথম রাজনৈতিক দল, যারা ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ডেল্টা প্ল্যান’-এর মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি সুস্পষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ইশতেহারের অঙ্গীকারগুলো পূরণে সচেষ্ট হয়েছিল। সংকট মোচন করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যে কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল, অত্যন্ত সততা ও বিশ্বস্ততার সঙ্গে তা বাস্তবায়ন করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আমাদের দেশের সর্বস্তরের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও তাদের অক্লান্ত শ্রম-ঘাম, মেধা এবং দেশ গঠনে আমাদের তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলেই গত ১০ বছরের সাফল্যগুলো অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। আত্মত্যাগ ও উৎসর্গ ছাড়া মহৎ কিছু অর্জন করা যে সম্ভব নয়, তা যুবসমাজ তখন প্রমাণ করেছিল। কষ্টসহিষ্ণু, সাহসী ও প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা যুবসমাজ অতীতের অন্ধকার ঘুচিয়ে বাংলাদেশকে আলোকোজ্জ্বল সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে টেনে নিয়ে গেছে।সমৃদ্ধ ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ নির্মাণে ছাত্রদের ভূমিকা বিশদ। শেখ হাসিনার ভিশনগুলো অর্জনে ছাত্ররা এখন যেমন অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে, তেমনি সামনের দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে বলে আমরা মনে করি। উন্নত বিশ্ব গড়ার জন্য তাদের মুখ্য ভূমিকায় দায়িত্ব দিতে হবে। অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি দরকার এই কারণে যে, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মোকাবিলা করতে বারবারই আমাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে। কোটি কোটি অর্থসম্পদের মালিক জামায়াতে ইসলামী আর এর বিত্তবান নেতারা সমাজের কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে না কখনো। তা ছাড়া তাদের যুদ্ধাপরাধী নেতারা এ দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চায়নি, বরং একাত্তর প্রসঙ্গে ধারাবাহিক মিথ্যাচার করে গেছে নানা সময়ে। দেশ পরিচালিত হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্রসমাজ দ্বারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশিত রাজনীতির সুস্থধারা অব্যাহত রাখতে হবে ছাত্রদের দেশের স্বার্থে। তবেই দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত রাখা সম্ভব হবে।
ড. মিল্টন বিশ্বাস, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মূল লেখাটি দৈনিক আমাদের সময়ে প্রকাশিত: লিংক