শনিবার, রাত ১০:২০ ২১শে ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
শ্রীচৈতন্য : বাঙালির প্রত্নপ্রতীক
/ ৬৭১ বার
আপডেট : শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

মাজ পরিবর্তনের জন্য ভারতবর্ষে প্রাক-আধুনিককালে কার্ল মার্কসের মতো ব্যক্তিত্বের জন্ম হয়নি সত্য, কিন্তু এখানকার সত্যান্বেষী সন্তদের প্রচেষ্টায় মানুষের প্রচলিত অনেক ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে প্রাচীনকাল থেকে_এটা বাস্তব। সন্তরা ভক্তি ও ত্যাগের দ্বারা সমাজে বিপ্লব সাধন করেছেন। ঐতিহাসিক বাস্তববাদের নিরিখে এ ধরনের বিপ্লব রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে হলেও তার একটি প্রভাব রয়ে গেছে মানুষের চেতনায়। বাংলার ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তিত্ব শ্রীচৈতন্য জাতি-বর্ণ-

ধর্ম-লিঙ্গ-নির্বিশেষে শ্রেণীহীন সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। কেবল কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছেন, ভক্তির পতাকাতলে মানুষের মুক্তি সম্ভব। মানুষকে মানুষ হিসেবে উচ্চবর্গের সমাজের কাছে উপস্থাপনের কৃতিত্ব তাঁর। দোল পূর্ণিমার তিথিতে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি যে শিশুটি ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন, পরবর্তীকালে তিনি বিশ্বম্ভর, নিমাই ও চৈতন্য নামের মধ্য দিয়ে বাঙালি সমাজের অবহেলিত মানুষের মুক্তির দূত হিসেবে আবির্ভূত হবেন_এটা কে বুঝতে পেরেছিলেন? তিনি ১৪৯১ থেকে ১৪৯৭ পর্যন্ত শাস্ত্রীয় বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। আনুমানিক ১৫০৫ সাল থেকে তাঁর অধ্যাপনার সূচনা ঘটে। ১৫০৮ সালে গয়াধামে ঈশ্বরপুরীর কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর নবদ্বীপে ফিরে ভাবপ্রকাশ ও সংকীর্তন শুরু করেন তিনি। ১৫০৯ সালের শেষ দিকে সংকীর্তনাদির অবসান ঘটিয়ে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হন ১৫১০ সালে। এরপর তিনি রাঢ়, নীলাচল, বঙ্গদেশ, বৃন্দাবন, প্রয়াগ, কাশী, শান্তিপুর প্রভৃতি জায়গায় ভ্রমণ করে ভক্তিবাদ প্রচার করেন। ১৫৩৩ সালের ২৯ জুন তিনি দেহান্তরী হন। বাংলায় বৈষ্ণববাদ প্রচারের ক্ষেত্রে শ্রীচৈতন্য স্বতন্ত্র দৃষ্টিকোণের পরিচয় দিয়েছেন। তবে তিনি মাধবেন্দ্রপুরী ও তাঁর শিষ্য ঈশ্বরপুরী দ্বারা প্রভাবান্বিত ছিলেন। ভাবাবেগ আশ্রিত চিন্তন প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁর নিজস্ব লেখনীর সন্ধান পাওয়া যায়নি। তিনি কেবল ‘শিক্ষাষ্টক’ নামক আটটি সংস্কৃত শ্লোক রচনা করেছিলেন। এগুলোতে খুব সহজ-সরলভাবে ভগবৎপ্রেম প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তাঁর শিষ্য-পারিষদরা একাধিক গ্রন্থ রচনা করে তাঁর জীবন ও ভাবনার স্বরূপ উন্মোচন করেছেন।
শ্রীচৈতন্য বিষ্ণুর অর্চনা নয় বরং কৃষ্ণের নামকীর্তন, তাঁর ধ্যান-ভজন ও লীলামৃত আস্বাদনকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কৃষ্ণ বিষ্ণুরই মনুষ্যদেহধারী অবতার; কৃষ্ণের লীলা মানব-ইন্দ্রিয় দ্বারা গম্য_এ ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। কৃষ্ণের ভজন, পূজন, নামকীর্তন ও লীলা মাহাত্ম্য উপলব্ধি বৈষ্ণবদের প্রধান ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য। তবে চৈতন্যের ভাবনা ধর্মাচরণের বিপক্ষে ছিল। বর্ণভেদের কণ্টকে পতিত জাতিধর্মের প্রতি ছিল তাঁর ভিন্ন মতাদর্শ। সংকীর্তনের মাধ্যমে ভক্তিবাদের পথে উপনীত হওয়ার কৃত্যই ছিল তাঁর প্রদর্শিত ধর্মাচরণ। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে চৈতন্যের ধর্মাচরণের পরিচয় পাওয়া যায়। বাহ্যজ্ঞানরহিত হরিনাম-কৃষ্ণনামে ভেসে যাওয়া চৈতন্যের পরিচয় নিম্নরূপ :
‘মেলিতে না পারে দুই চক্ষু প্রেম-জলে।
সবে মাত্র কৃষ্ণ কৃষ্ণ শ্রীবদনে বলে
ধরিয়া সভার গলা কান্দে বিশ্বম্ভর।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ ভাই সব বল নিরন্তর
প্রভুর দেখিয়া আর্ত্তি কান্দে ভক্তগণ।
কারো মুখে আর কিছু না স্ফুরে বচন ‘
(চৈতন্যভগবৎ, মধ্যম খণ্ড : প্রথম অধ্যায়)
চৈতন্য আচারসর্বস্ব ও রক্ষণশীল সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করেছেন। মধ্যযুগের যে সময় স্মার্ত বা নব্য ন্যায়নিষ্ঠ ব্রাহ্মণদের দোর্দণ্ড প্রতাপ সে সময় তিনি তাদের সঙ্গে সরাসরি রাজনৈতিক সংঘাতে লিপ্ত না হয়ে বৈষ্ণব ধর্মচিন্তার দ্বারা আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এ চিন্তার মূলে ছিল ঈশ্বরভক্তির সহজ-সরল পথ। তবে সর্বদাই কৃষ্ণনাম জপ করো, সংকীর্তন করো, হরিনামে নিমগ্ন থাকো_এমন এককেন্দ্রিক চিন্তাধারায় তিনি নিবিষ্ট থাকেননি। তাঁর ভাবনায় মানুষের মুক্তি, সমাজের অসংগতি দূর করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে দেখা যায়।
চৈতন্য সমাজসংস্কারক ছিলেন। ঈশ্বরের দাস হিসেবে তিনি জাতের বিচার করেননি। ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল, হিন্দু-মুসলমান, দেশি-বিদেশি, নারী-পুরুষ সবাইকে একই দৃষ্টিতে দেখার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিভেদ দিয়ে সমাজের নিচের তলার বাস্তবতা বোঝা যায়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের ফলে জাতে জাতে পারস্পরিক সম্পর্কের চেহারা সর্বত্রই এক রকম নয়। শ্রীচৈতন্য সমাজে অখণ্ড আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। জন্মগতভাবে নিজে ব্রাহ্মণ হয়েও সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করেছেন এবং মুক্তচিন্তার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর একমাত্র পরিচয় বৈষ্ণব। জাতপাতের ঊধর্ে্ব তাঁর এই চেতনা উত্তর ভারতের বহু সন্তর মতোই। যদিও তাঁরা নিম্নবর্গীয় ছিলেন, কিন্তু শাস্ত্রীয় মার্গকে অস্বীকার করেছিলেন। তবে চৈতন্য উচ্চবর্গের পরিসর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রথম দিকে তাঁর জন্মগত বর্ণসমাজের বিরুদ্ধাচরণের মধ্যে পড়তে হয় তাঁকে। ব্রাহ্মণসমাজ তাঁকে উন্মত্ত ভেবেছে, জাতনাশের শঙ্কায় শঙ্কিত হয়েছে। কিন্তু ভক্তির স্রোতে সর্বজনীন মানুষের প্লাবনে ভীত হয়েছে। তাঁকে মেনে নিয়েছে। চৈতন্যদেবের বৈষ্ণব ধর্ম ছিল অতীন্দ্রিয়বাদ, জাতিভেদের কলুষতাবিরোধী ও বুদ্ধিবাদবিরোধী।
শ্রীচৈতন্যের ভাবনার অপব্যাখ্যা ও সমন্বয়ী শ্রেণীহীন সমাজ বজায় রাখার প্রচেষ্টা একসময় ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর সন্ন্যাস গ্রহণ (১৫১০), চিরদিনের মতো নবদ্বীপ ত্যাগ (১৫১০), উত্তরকালে মধুরভাবে বিভোর হয়ে পড়া (১৫১৫-১৫৩৩) এবং সব শেষে তাঁর অনুপস্থিতিতে (১৫৩৩ সালে মৃত্যুর পর) ষড় গোস্বামীদের নেতৃত্বে শক্তিশালী বৃন্দাবন গোষ্ঠীর পরিচালনায় গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে ব্রাহ্মণদের উচ্চাসনে প্রতিষ্ঠার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। চৈতন্য-উত্তর বৈষ্ণব সমাজে বিভিন্ন মতাদর্শের ভ্রান্ত-অভ্রান্ত পথে সাধনমার্গে বিচিত্র স্খলন ঘটলে বৃন্দাবন গোষ্ঠী যে অনুশাসনের বন্ধনে চৈতন্য দর্শনকে বৃত্তাবদ্ধ করেছে, তাতে ব্রাহ্মণ শ্রেণীর বৈষ্ণবদের উচ্চবর্ণে অধিষ্ঠান অনিবার্য হয়ে ওঠে। ফলে চৈতন্যভাবনার জাত-বর্ণহীন আদর্শ বিচ্যুত হয়। মূলত শ্রীচৈতন্য প্রথম থেকে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে ভক্তিবাদ প্রচার ও ধর্মাচরণে সামাজিক জীবনের কলুষতামুক্ত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত থাকলেও বৈষ্ণব সমাজে জাতপাতের নিয়মকানুন প্রচলিত হতে শুরু করে ১৫৭৬ থেকে ১৫৮২ সালের মধ্যে অনুষ্ঠিত খেতুড়ির (রাজশাহী) সম্মেলনের পর থেকে। খেতুড়ির সম্মেলন থেকে বিভিন্ন নির্দেশ প্রচারিত হলে বৈষ্ণব ধর্মের অনাড়ম্বর রূপটি বর্জিত হতে থাকে।
চৈতন্যের সময় থেকে বৈষ্ণবদের মধ্যে পেশাগতভাবে গৃহস্থ সমাজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। আখড়াধারী, ভিক্ষাজীবী বা গৃহী_এ রকম বৈষ্ণব লোকায়ত সমাজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে বৈষ্ণবদের সমাজের ভেতরই ধর্মাচরণের পক্ষে ছিলেন চৈতন্য ও তাঁর পরিকররা। ঘরে ঘরে গৃহস্থদের মধ্যে ‘নাম’ প্রচার করাই তাঁদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু ক্রমান্বয়ে বৈষ্ণবীয় পরিমণ্ডলে সন্ন্যাসের তত্ত্ব ও অভ্যাস প্রচলিত হয়। একদিকে সন্ন্যাসব্রত, দারিদ্র্যবরণ, চরম দুঃখভোগ অন্যদিকে সম্পত্তি অর্জনের প্রবৃত্তি, গুরুবাদকে ভাঙিয়ে আত্মোন্নতি, পুষ্পমাল্য, পতাকা এবং সম্ভাব্য ক্ষেত্রে সেবাদাসী গ্রহণ প্রচলিত হয়। লোকায়ত সমাজের জনগোষ্ঠী অসহায় গ্রামীণ মানুষ। উচ্চবর্গের সমাজপতিদের উপেক্ষা-বঞ্চনা থেকে পালিয়ে আশ্রয়ের জন্য অবলম্বন করেছে বৈষ্ণব ধর্ম। গ্রামীণ পরিমণ্ডলে সমাজ ও অর্থনীতির বিপন্ন সময়ে এই জনগোষ্ঠী যে সহজ স্বাভাবিক ধর্মাচার গ্রহণ করেছে, তাতে দেহধারী ইন্দ্রিয়পরায়ণ মানুষই বিবেচ্য হয়ে উঠেছে।
মধ্যযুগ থেকেই শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত ভগবৎপ্রেমের ধারায় সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ সম্পৃক্ত হয়েছে, পরিগণিত হয়েছে বৈষ্ণব সম্প্র্রদায়ে। এদের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে বৈষ্ণব সমাজের অনুশাসন দ্বারা। এদের বেশির ভাগই জাতিতে চণ্ডাল, ডোম, মুচি, সদগোপ। বৈষ্ণবীয় সাধন-ভজন তাদের ধর্মাচরণের অঙ্গ। রসকলি ও মালাতিলক ব্যবহারকারী এরা, এরা বিনয়ী। একতারা ও খঞ্জনী নিয়ে গান গেয়ে মাধুকরী বৃত্তিকেই গ্রহণ করতে দেখা যায় এদের বেশির ভাগকে। আত্মপ্রচারণা কিংবা নিন্দা করা এরা পছন্দ করে না।
জাতভেদের আস্তরণ সরিয়ে উচ্চবর্ণের মানুষের মনে অন্ত্যজ-ব্রাত্য জনগোষ্ঠী সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় শ্রীচৈতন্যের অনুচিন্তনের অন্যতম প্রান্ত। শাস্ত্রীয় অনুজ্ঞা লঙ্ঘন, মূর্তিপূজার বিরোধিতা, জাতিভেদ-প্রথার প্রতি অনাস্থা ও নিম্নজাতির বা জাত খোয়ানো মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্ম সামাজিক মানুষের কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। চৈতন্য পতিত ও নিচে পড়ে থাকা মানুষকে আলিঙ্গন করতেন, ডোমের হাতে অর্থাৎ নীচু জাতের হাতে জল খেতেন, মুচিকে সম্মান করতেন_জাতপাতহীন সেই অসাম্প্র্রদায়িক চেতনা একান্তই উনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের তুল্য। শ্রীচৈতন্য মধ্যযুগের বাঙালি সমাজের নবজাগরণের প্রত্নপ্রতীক।
[শিলালিপি ২১ এপ্রিল ২০১১]

মূল লেখাটি দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত

আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Total Post : 19